Ajker Patrika

আমাদের হলোটা কী-৪

জাহীদ রেজা নূর
আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০২২, ১১: ৩৫
আমাদের হলোটা কী-৪

সম্প্রতি এইচএসসি পরীক্ষার দুটো প্রশ্নপত্র নিয়ে তোলপাড় হয়েছে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। প্রথম প্রশ্নপত্রটি নজরে আসার পর ‘অপদার্থ!’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম। কিন্তু দু-এক দিনের মধ্যেই সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আনিসুল হককে হেয় করে কারিগরি বোর্ডের প্রশ্নপত্রে একটি প্রশ্ন ছাপা হওয়ার পর ব্যাপারটাকে নিছক আহাম্মকি বলে ছেড়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো কোনো শিক্ষকের মননে একটা বড় ফাঁক তৈরি হয়েছে। এই ফাঁক পাকা ফোড়ার মতো এতটাই বিকশিত হয়েছে যে কোনোভাবেই তাকে আর শুশ্রূষা করা যাচ্ছে না। দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ নিয়ে তা শিক্ষার শরীরেই অবস্থান করছে।

দীর্ঘকাল আমি আনিসুল হকের সহকর্মী ছিলাম। ২১ বছর ধরে একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে যে সখ্য হয়েছিল, তাঁর দিক থেকে যে প্রীতির পরশ পেয়েছি, সেই আবেগে নিমজ্জিত হয়ে এ লেখাটি লিখছি না। একেবারে নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান থেকেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইছি।

২. আনিসুল হকের লেখা কেউ পছন্দ করতে পারেন, কেউ অপছন্দ করতে পারেন। তাঁর লেখা ‘গদ্য কার্টুন’ নামে কলামটি খুবই জনপ্রিয় ছিল। তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাস নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁর কাজ আছে। কাছে থেকে দেখেছি, দেশের স্বাধীনতা, অসাম্প্রদায়িকতা, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামসহ বহু ব্যাপারেই তিনি সোচ্চার একজন মানুষ। তাঁর সব লেখাই সবার পছন্দ হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এটা পাঠকের নিজের রুচির ওপর নির্ভর করে। হুমায়ূন আহমেদকেও সবাই পছন্দ করতেন—এ কথা বলা যায় না। আবার এ-ও তো সত্য, তরুণ প্রজন্মের বিপুলসংখ্যক পাঠক ছিলেন হ‌ুমায়ূন-ভক্ত। বইমেলায় সারি বেঁধে হ‌ুমায়ূনের বই কেনার জন্য ক্রেতার ভিড়ের কথা কি ভোলা যাবে? আবার আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভক্ত ও সমালোচকেরা দুদিকেই থাকবেন, কোনো সন্দেহ নেই। হাসান আজিজুল হককে নিয়েও কথা হবে দুদিক থেকেই। পরের উদ্ধৃত লেখক দুজনের বই লাইন ধরে কেনা হতো না। কিন্তু তাতে তাঁদের রচনাশৈলী কালোত্তীর্ণ নয়, এই ফতোয়া কি দেওয়া যায়? কিংবা বলে দেওয়া যায় যে ইলিয়াস বা হাসান ব্যর্থ লেখক? কেউ যদি মনে করেন, হুমায়ূন আহমেদকে ভালো লাগে বলে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে আপনার ভালো লাগতে পারে না, কিংবা কেউ যদি প্রশ্ন করেন, ‘যিনি জীবনানন্দকে ভালোবেসে পড়েন, তিনি আবার রবীন্দ্রনাথ পড়েন কীভাবে—’, তাহলে বুঝতে হবে, বোঝাপড়ায় কোথাও একটা ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। এই ঘরানাপ্রীতিই পাঠককে বিভাজিত করে রেখেছে। পড়াশোনাকে করে তুলতে চাইছে একরৈখিক। আর এই প্রবণতা থেকেই এক লেখককে খাটো করে অন্য লেখককে বড় করে তোলার খেলা চলছে অবিরত। পাঠকমন যদি বৈচিত্র্যের সন্ধান করে, তাহলে তার ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করা যাবে না। এই প্রবণতাই সাহিত্যে রসাস্বাদনের পথকে খণ্ডিত করে ফেলে। এ কারণেই বিভিন্ন ‘ইজম’ এসে পাঠকের মনকে কাঁপিয়ে দেয়।

এ হলো সাহিত্য জগতের কথা। শিক্ষকের করা প্রশ্নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে এ আলোচনার হয়তো সম্পর্ক নেই। কিন্তু পরোক্ষভাবে আছে বৈকি! যে শিক্ষক প্রশ্ন করবেন, তিনি সাহিত্যের গতিপথগুলোর ব্যাপারে একেবারে অজ্ঞ থাকবেন কিংবা একজন নির্দিষ্ট লেখক সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে তাঁকে হেয় করবেন, এ কেমন কথা? একজন শিক্ষার্থীর কাছে কীভাবে একজন সাহিত্যিককে তুলে ধরতে হয়, কী করে প্রকৃত সাহিত্যের প্রতি তাকে আগ্রহী করে তুলতে হয়, সেটা একজন সম্মানিত শিক্ষক বুঝবেন না, তা কী করে হয়? প্রশ্নপত্রে একজন সাহিত্যিককে এবং তাঁর রচনাকে অপমান করার ঘটনাটি কি নিছক ভুল বলে অগ্রাহ্য করা যায়? এটা তো রুচির বিকার। তাঁর এই রুচিহীনতায় হতাশ হওয়া ছাড়া আর উপায় কী?

৩. কারিগরি বোর্ডের প্রশ্নকর্তা কী ভেবে আনিসুল হককেই ব্যর্থ সাহিত্যিক হিসেবে বেছে নিলেন? বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের যে রচনাটির সূত্র ধরে সাহিত্যিক আনিসুল হকের নাম তিনি টেনে এনেছেন তাঁর করা প্রশ্নে, সেটি কতটা প্রাসঙ্গিক? মজার ব্যাপার হলো, যখন আনিসুল হকের সঙ্গে একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম, তখন বঙ্কিমের এ রচনাটি নিয়ে বেশ জম্পেশ আড্ডা হয়েছিল আমাদের। সেখানে বঙ্কিমের রচনাটিতে লেখা পয়েন্টগুলোর সঙ্গে উপস্থিত সবাই একমত হয়েছি এবং বহুকাল আগে লেখা বঙ্কিমের কথাগুলো যে এখনো এতটা প্রাসঙ্গিক, তা ভেবে অবাক হয়েছি। মনে পড়ে, আনিসুল হকই প্রসঙ্গটির উত্থাপন করেছিলেন এবং পড়ে শুনিয়েছিলেন। একুশের বইমেলা এলেই আনিসুল হক অত্যন্ত অগোছালোভাবে বই তৈরি করেন, এ তথ্য প্রশ্নকর্তা পেলেন কোথায়? আনিসুল হককেই তিনি টার্গেট করলেন কেন? এবং কেন অবলীলায় এমন সব তথ্য তিনি প্রশ্নপত্রে রাখলেন, যাতে প্রমাণ করার চেষ্টা থাকল, আনিসুল হক তাড়াহুড়ো করে বই লেখেন, পাঠকের কাছে তা খাপছাড়া লাগে? শুধু কি তা-ই? সবচেয়ে ভয়ানক কথা হলো, শিক্ষার্থীকে ব্যাখ্যা করতে বলা হলো, আনিসুল হক কোন কারণে ব্যর্থ?

জাহীদ রেজা নূর৪. একজন সম্মানীয় শিক্ষক যখন নিজে কী করছেন, সেটা বুঝতে পারেন না; বুঝতে পারেন না তাঁর একটি অসতর্ক ভাবনা কীভাবে একজন সম্মানীয় সাহিত্যিককে হেয় করে সাংস্কৃতিক আবহ বিনষ্ট করে দিতে পারে, তখন ভাবতেই হয়, আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে হচ্ছেটা কী? ভাবতে হয়, আমাদের রুচির দীনতা কোথায় গিয়ে নেমেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে মনে হয়, এখনো যাঁরা বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি, বাংলা সাহিত্যের প্রতি আস্থা রাখছেন, তাঁদের সামনে অন্ধকার নেমে আসছে। কারণ সংস্কৃতি তো বেড়ে ওঠে মনের কর্ষণে, শিক্ষকের মনোভূমি কর্ষিত না হলে যে শিক্ষার্থীরা বেড়ে উঠবে তাঁদের ছায়ায়, তারা তো পরিণত হবে মজা খালে, সে সত্য কি এড়িয়ে যাওয়া যাবে?

শিক্ষালয় থেকেই যদি সাহিত্যিকদের প্রতি অসম্মান করা শুরু হয়, তাহলে এই শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে কাকে আর সম্মান করবে? সাংস্কৃতিক সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রশ্নকারী শিক্ষকের, মডারেটরদের এবং শিক্ষা বোর্ডের প্রধানের উচিত প্রকাশ্যে সাহিত্যিক আনিসুল হকের কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং ভবিষ্যতে প্রশ্নকর্তারা যেন রুচির জায়গাটিতে নান্দনিকতার চাষবাস করতে থাকেন, সেটাও নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

কয়েক দিনের ব্যবধানে এ রকম অপমানজনক দুটি প্রশ্নপত্রের দেখা মিলল। তাতে মনে হয়েছে, এ রকম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের ক্ষেত্রে শুধু প্রশ্নকর্তা আর মডারেটরদের ওপর আর নির্ভর করা যায় না। আরও দায়িত্বশীল কেউ কি আরেকটু সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে প্রশ্নগুলো নেড়েচেড়ে দেখবেন?

৫. একটি দেশে দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরি করার কাজে যাঁরা নিয়োজিত, তাঁদের কেউ কেউ যদি নিজেরাই দায়িত্বহীন হন, তাহলে ভবিষ্যতের বিপদগুলো বাড়বে। আমরা ক্ষমা করতে শিখিনি—এ কথা বলার আগে জানতে হবে, আমরা ক্ষমা চাইতে শিখেছি কি না।বিষয়টি কেবল আনিসুল হককে নিয়ে নয়। অসতর্ক হলে তার জায়গায় যেকোনো নামই আসতে পারে। মূলত শিক্ষাব্যবস্থাটাই আমাদের এরকম একটি উদ্ভট জায়গায় নিয়ে এসেছে। সেটা বদলানো না হলে ঘটনাগুলো যে আরও ঘটতে থাকবে, সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

আনিসুল হক চাইলে মানহানির মামলা করতে পারেন অথবা অপমানকারীদের ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু অপমানের যে ক্ষতটি তাঁকে বহন করতে হবে, তার দায় কি নেবেন এই শিক্ষকেরা? মনে করার কোনো কারণ নেই, স্কুল বা কলেজের শিক্ষকদের কতটা বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়, সে কথা আমরা জানি না। যাঁরা নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলবেন, তাঁদের আর্থিক অবস্থা আরও স্বস্তিকর হওয়া দরকার। তেমনি তাঁদের তো আরও বেশি মানবিকও হতে হবে। মানুষ গড়ার কারিগরদের মনে কোনোভাবেই ব্যক্তিকে, ধর্মকে, গোষ্ঠীকে হেয় করার চিন্তা আসতেই পারে না। যদি আসে, তবে তিনি আসলে মানুষ গড়ে তোলার যোগ্য কেউ নন।

লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত