Ajker Patrika

নতুন ভাঙনের অপেক্ষায় পাকিস্তান

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
নতুন ভাঙনের অপেক্ষায় পাকিস্তান

পাকিস্তানের একদা প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যে অত্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তিনি একাধিকবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু তাঁর একাধিক স্ত্রী তাঁকে ত্যাগ করে চলেও গেছেন। তাঁর গৌরবের অংশীদারির অতি উজ্জ্বল ও ভারী বোঝাটি বহন করে চলাটা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

ক্রিকেটে বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে পাকিস্তান যে একবার মহাচাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল, সেটা ঘটেছিল ইমরান খানেরই নেতৃত্বে। ক্রিকেট টিমে তিনি পিতার মতোই ছিলেন। পরে তিনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন; সেখানেও ব্যবস্থাটা পুরোপুরি পিতৃতান্ত্রিক। তাঁর কথাতেই সবকিছু চলে। রাষ্ট্রও তাঁর কথামতো চলবে, প্রধানমন্ত্রী হয়ে এমনটাই ছিল তাঁর প্রত্যাশা। 

কিন্তু বিপদ ঘটিয়েছে তাঁর তুলনাতেও যারা সুগঠিত ও সশস্ত্র এবং সে কারণে ক্ষমতাবান, সেই সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর সমর্থন পেয়েই তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তা না হলে কস্মিনকালেও হতে পারতেন না। কিন্তু সেনাবাহিনীর কর্তারা মনে করেছেন, ক্ষমতা হাতে পেয়ে খান সাহেব বাড়াবাড়ি করছেন, তাঁদের তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছেন না। তখন তাঁরা নাড়াচাড়া দিয়েছেন এবং তাতে করে তিনি ভূতলে পতিত হয়েছেন। অতুলনীয় জনপ্রিয় নেতা ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো, তাঁকে পর্যন্ত যে বাহিনীর কর্তারা ছাড় দেননি, ‘বেয়াদবি’ করছেন মনে করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা ইমরান খানের দম্ভকে সহ্য করবেন কেন? ইমরান খান প্রধানমন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন।

কেবল তা-ই নয়, তাঁকে মামলায় ফেলে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া তো হয়েছেই, পাঁচ বছর কোনো নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না—এমন বন্দোবস্তও শাস্তিদাতারা দিতে ভুল করেননি। কারাগারে যাতে তিনি কষ্ট পান, সেটাও সুনিশ্চিত করা হয়েছে। তাঁকে রাখা হয়েছে ইংরেজদের তৈরি সবচেয়ে খারাপ এক জেলখানার নিম্নমানের একটি সেলে, যেখানে ঠিকমতো আলো-বাতাসের যাতায়াত নেই। মশা-মাছি, পোকামাকড় ভনভন করে। খাবারদাবারের ব্যবস্থাও অত্যন্ত খারাপ। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ইসলামাবাদে। রায় বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে ত্বরিতগতিতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে লাহোরে, তাঁর বাড়ি থেকে।

আর কী আশ্চর্য, এমনকি পাকিস্তানের ক্রিকেটের ইতিহাস থেকেও তাঁর নাম মুছে ফেলার আয়োজন করা হয়ে গেছে। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের জন্মদিবস; ওই দিবস পালন উপলক্ষে পাকিস্তানের ক্রিকেট বোর্ড যে ভিডিওটি প্রকাশ করেছে, তাতে নাকি তাঁর নামের উল্লেখ পর্যন্ত নেই। ইমরান খানের পরে পাকিস্তানের যিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, শাহবাজ শরিফ (এখন আর নেই), তিনি যে বলেছেন, ‘সামরিক বাহিনীর সমর্থন ছাড়া সরকার চালাতে পারি না।’ সেটা এমনি এমনি বলেননি, অভিজ্ঞতা থেকেই জেনে-বুঝে বলেছেন। 

ইমরান খানের নিজের অভিজ্ঞতাও অত্যন্ত মর্মান্তিক। পদ হারানোর পরে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করতে এসে এমনভাবে তাঁর বাড়ি ঘেরাও করেছিল, মনে হচ্ছিল যে পাকিস্তানের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তিনি একজন। পেছনে যে সামরিক বাহিনী ছিল, এটা তো তিনি জানতেনই। কিন্তু এটা মোটেই তাৎপর্যহীন নয় যে ওই সময়ে তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে যে নৃশংসতা চালিয়েছিল তার কথা। তাঁর কথাগুলো বেশ হৃদয়স্পর্শী। যেমন ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যে নির্মমতার শিকার হয়েছিল তা আমরা বুঝতে পারি।’ এখন পারেন ঠিকই, আগে কিন্তু বুঝতে পারেননি। বুঝতে চানওনি।

এখন যখন নির্যাতন সরাসরি নিজের ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে, তখন তো আর না বুঝে উপায় নেই। আর পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর অতিনৃশংস আচরণ যারা করেছিল, তারা কারা? তারা তো ইমরান খান সাহেবদেরই আপনজন, চাচা-ভাতিজা, ভাই-বেরাদার। পূর্ববঙ্গে গণহত্যার বড় নায়কদের একজন, ‘ব্যাঘ্র’ নিয়াজি নামের সেই লোকটা তো শুনেছি ইমরান খানেরই আপন চাচা। ওই চাচাদের পাপেই তো আজ ইমরান খান সাহেবের এমন নাজেহাল দশা। যে বাঘ একবার নররক্তের স্বাদ পেয়ে গেছে, সে কি সহজে তৃপ্ত হয়? 

ইমরান খানের বর্তমান উপলব্ধিটা অত্যন্ত পরিষ্কার। যেমন ‘বাংলাদেশের জন্ম আট মাসে ঘটে যায়নি’ এবং ‘আমাদের বোঝা উচিত যে পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের ওপর কত বড় অত্যাচার করা হয়েছে। যে দল নির্বাচনে জিতেছিল, যাকে তারা প্রধানমন্ত্রী করতে চেয়েছিল, সেটা হতে দেওয়া হয়নি। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে মিলিটারি অ্যাকশন নিয়ে নিল [...] এখন যেভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে, তখন পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের ওপর সেভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল। আমাদের অবস্থা ১৯৭১-এর পূর্ব পাকিস্তানের মতো। খবর চাপা রাখা হচ্ছে।’ তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, পাকিস্তানের অবস্থা পূর্ব পাকিস্তানের মতোই হতে পারে; অর্থাৎ পাকিস্তান ভেঙে যেতে পারে। তাঁর এই শঙ্কা মোটেই অমূলক নয়।

পাকিস্তানের উদ্ভব ঘটেছিল উদ্ভট এক রাষ্ট্র হিসেবেই। তাকে গড়ে তোলার ও রক্ষা করার দায়িত্ব রাজনীতিকেরা নিতে পারেননি, সেনাবাহিনীই নিয়ে নিয়েছিল। সেনাবাহিনীর জোরটা অস্ত্র ভিন্ন অন্য কিছুর ছিল না। অস্ত্রের দ্বারা মানুষ মারা যায় ঠিকই, কিন্তু জাতি গঠন যে অসম্ভব, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা সুন্দরভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। কয়েকটি জাতি নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র যে পাকিস্তান, তাকে টিকিয়ে রাখার সাধ্য ইমরান খানের তো নেই-ই, সেনাবাহিনীরও নেই। একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙেছে বড় মাত্রায়; এখন অপেক্ষায় রয়েছে নতুনতর ভাঙনের।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

বগুড়ায় ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা, পাঁচ নেতা-কর্মীকে শোকজ

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত