ড. মইনুল ইসলাম
সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে। দেশের আমদানি ব্যয় ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধির পেছনে এটাও বড় কারণ। কিন্তু আমদানি এলসি বেলাগাম গতিতে বাড়ার পেছনে প্রধান কারণ ওভার ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে বিদেশে পুঁজি পাচার বেড়ে যাওয়া।
শ্রীলঙ্কার ‘লঙ্কাকাণ্ড’ দেশটাকে চরম অরাজকতায় ডোবাতে চলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ ছিল শ্রীলঙ্কা। প্রায় শতভাগ জনগণ ছিল শিক্ষিত। দেশটির স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছিল ভারতের কেরালার পর দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। চাল উৎপাদনে শ্রীলঙ্কা ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। মানুষের মাথাপিছু জিডিপি ছিল প্রায় ৪ হাজার ডলার। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা ছিল সবচেয়ে অগ্রগামী। ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধে বিজয়ের পর চীনের ঋণের অর্থে শ্রীলঙ্কা অনেকগুলো স্বল্প-প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করে। এর পাশাপাশি ‘সভরেন বন্ড’ ছেড়ে তারা দেশ-বিদেশের অর্থবাজার থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার ঋণ সংগ্রহ করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করার প্রয়াস চালায়। কিন্তু প্রকল্পগুলো থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে মাহিন্দাসহ রাজাপক্ষে পরিবারের অন্য সদস্যরা কোটি কোটি ডলার আত্মসাৎ করার অভিযোগ চরম আকার ধারণ করায় ২০১৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাহিন্দা রাজাপক্ষে মাইথ্রিপালা সিরিসেনার কাছে পরাজিত হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন।
কিন্তু সিরিসেনা সরকার মাহিন্দার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলো প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাহিন্দার ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষে অনেকগুলো ‘পপুলিস্ট’ অঙ্গীকারের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার ভোটারদের মন জয় করে আবার বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হন। ওই নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী গোতাবায়া ১৫ শতাংশ জেনারেল সেলস ট্যাক্সকে ৮ শতাংশে নামিয়ে ফেলেন এবং ২ শতাংশ ন্যাশনাল রিবিল্ডিং ট্যাক্সকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এতে খুশি হয়ে ২০২০ সালের সংসদীয় নির্বাচনে ভোটাররা রাজাপক্ষে পরিবারের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলকে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা সহকারে বিজয় এনে দেয়। মাহিন্দা আবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান, তাঁর সঙ্গে মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন বাসিল রাজাপক্ষে, চামাল রাজাপক্ষে এবং পরবর্তী জেনারেশনের আরও দুজন রাজাপক্ষে। পরিবারতন্ত্র আর কাকে বলে! কিন্তু, এক দশকের ‘ঋণ করে ঘি খাওয়ার’ নীতি ২০২০ সালেই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে শুরু করে। আয় বাড়াতে ব্যর্থ হয়ে চীনের অর্থে নির্মিত হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দরকে ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছে লিজ দিতে বাধ্য হয় শ্রীলঙ্কা। একই সঙ্গে হাম্বানটোটায় নির্মিত রাজাপক্ষে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটিও একেবারেই স্বল্প-ব্যবহৃত বিমানবন্দর হিসেবে বোঝায় পরিণত হয়।
অন্যদিকে ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি আঘাত হানার পর শ্রীলঙ্কায় মানুষ বেশি মারা না গেলেও অর্থনীতিতে বেশ কয়েকটি মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক আয়ের সবচেয়ে বড় সূত্র পর্যটন খাতের আয় মহামারির ফলে রাতারাতি শূন্যে নেমে আসে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের রেমিট্যান্সে মহামারি-সৃষ্ট ধস, যাতে দেশটির ফরমাল চ্যানেলের রেমিট্যান্স আয়ও প্রায় ৮০ শতাংশ সংকুচিত হয়ে যায়। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, রাতারাতি কৃষি খাতে ‘অরগানিক ফার্মিং’ চালুর জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক আমদানি নিষিদ্ধ করে প্রদত্ত প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত, যার ফলে এক অভূতপূর্ব ফলন-বিপর্যয়ে পতিত হয় শ্রীলঙ্কার কৃষি খাত। ফলে শ্রীলঙ্কার কৃষিজাত খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এক বছরে বিপর্যয়করভাবে এক-তৃতীয়াংশ কমে যায়, এবং খাদ্যশস্য আমদানির জন্য ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কাকে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়। এসব বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালেই শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমে বিপজ্জনক স্তরে চলে আসে। আমদানি করতে অসমর্থ হওয়ায় জ্বালানি তেল, এলএনজি, ভোজ্যতেল, চিনি, চাল এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি চরম আকার ধারণ করে, মানুষ রাস্তায় নেমে আসে রাজাপক্ষে পরিবারের উৎখাতের দাবিতে। ২০২২ সালের এপ্রিলে রিজার্ভ মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলারে নেমে যাওয়ায় শ্রীলঙ্কা নিজেকে ঋণখেলাপি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। শ্রীলঙ্কার মতো একদা-সমৃদ্ধ একটা অর্থনীতি যে এভাবে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে, সেটাই অচিন্তনীয় ছিল দুই মাস আগেও। অথচ বিশ্বকে এই অবিশ্বাস্য পতন প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে এখন। অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত জনগণ এপ্রিল মাসজুড়ে কলম্বোর রাজপথে রাজাপক্ষে পরিবারের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের পদত্যাগের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মাহিন্দা রাজাপক্ষের এক অবিমৃশ্যকারী ‘রাজনৈতিক গুন্ডামির’ কারণে ৯ মে এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন মারাত্মক সংঘাতপূর্ণ গৃহযুদ্ধে পর্যবসিত হলো, যেখানে একজন সংসদ সদস্যসহ আট ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। আন্দোলনের তীব্রতায় প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার পর মাহিন্দা তাঁর সমর্থকদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাসে করে কলম্বোয় নিয়ে আসেন। এই ভাড়াটে গুন্ডারা বিনা উসকানিতে মাসাধিককাল ধরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জনতার ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে ও আরও বহু মানুষকে মারাত্মকভাবে আহত করে। এই হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার মানুষ ঘটনাস্থলে ছুটে আসে এবং গুন্ডাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এর জেরে সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীরা সরকার-সমর্থকদের গণপিটুনি দেওয়ার পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং রাজাপক্ষে পরিবারের বাড়িঘর আগুনে পোড়ানো শুরু করে দেয় এবং অনেককে মারধরের পাশাপাশি পানিতে চুবানো শুরু করে। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিশিয়াল বাসভবনে জনতা ঢুকে পড়তে উদ্যত হলে মাহিন্দা এবং তাঁর পরিবার হেলিকপ্টারে চড়ে সেখান থেকে ভেগে গিয়ে ত্রিনকোমালির একটি নৌঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়। এখন গোতাবায়ার যাওয়ার পালা।
শ্রীলঙ্কার এই চলমান গণ-অভ্যুত্থান থেকে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর জন্য অনেকগুলো শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও খামখেয়ালিপনা, পারিবারিক একনায়কতন্ত্র, হঠকারী সিদ্ধান্ত এবং অর্থনৈতিকভাবে অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজাপক্ষে পরিবার দুই বছরের মধ্যেই শ্রীলঙ্কার মতো একটি সমৃদ্ধ অর্থনীতিকে ধসিয়ে দিয়েছে এবং দেউলিয়া করে ফেলেছে। ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বেশ কয়েক বছর শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের বেশি হয়েছিল, কিন্তু ‘ঋণ করে ঘি খাওয়ার’ এই নীতি রাজাপক্ষে পরিবারের শাসনকে অবশ্যম্ভাবী পতনের দিকে ধাবিত করেছে এবং শ্রীলঙ্কার জনগণকেও দুর্দশার অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করেছে। করোনাভাইরাস মহামারি এই পতনকে ত্বরান্বিত করেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক মহাসংকটের আলামতগুলো মহামারির বহু আগেই স্পষ্ট দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। নির্বাচিত সরকার হলেই খামখেয়ালি ও স্বেচ্ছাচারিতার লাইসেন্স জনগণ কাউকে দেয় না। বিদেশি ঋণ পাওয়া গেলেই যথার্থ প্রকল্প মূল্যায়ন ব্যতিরেকে কারও ইচ্ছামাফিক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের পরিণাম কখনোই শুভ হয় না। বাংলাদেশেও প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের পরিবর্তে যদি গ্ল্যামারাস ও স্বল্প-প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ অব্যাহত থাকে, তাহলে শ্রীলঙ্কার মতো ঋণগ্রস্ততার ফাঁদে পড়তে বাংলাদেশেরও দেরি হবে না। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২০২২ সালের মে মাসে ৪১ বিলিয়ন ডলার হয়ে গেছে। চলমান মেগা-প্রজেক্টগুলোর ব্যয়ের ধারাবাহিকতায় বৈদেশিক ঋণ ৯১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে বাংলাদেশের আমদানি গত বছরের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বেড়ে গেছে, যেটাকে আসন্ন মহাবিপদের ‘অশনিসংকেত’ আখ্যায়িত করাই সমীচীন। এই গতিতে আমদানি এলসি খোলা অব্যাহত থাকলে ২০২২ সালের ৩০ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের মোট আমদানি ৮২-৮৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। এর মানে, এই অর্থবছরের রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর প্রাক্কলন সত্ত্বেও অর্থবছরের শেষে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমান অর্থবছরে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে যাবে। অতএব, আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে এ বছর প্রায় ১০-১২ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে।
করোনাভাইরাস মহামারির তাণ্ডব কমতে না কমতেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং আগ্রাসন মোকাবিলায় পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তায় ইউক্রেনের মরণপণ প্রতিরোধ সারা বিশ্বকে এক ভয়াবহ যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে নিক্ষেপ করেছে। সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে। দেশের আমদানি ব্যয় ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধির পেছনে এটাও বড় কারণ। কিন্তু আমদানি এলসি বেলাগাম গতিতে বাড়ার পেছনে প্রধান কারণ ওভার ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে বিদেশে পুঁজি পাচার বেড়ে যাওয়া। উপরন্তু করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে হুন্ডি পদ্ধতি বেশ খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছিল চাহিদা এবং সরবরাহ—দুই দিক থেকেই। এখন আবার হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হয়ে উঠেছে। কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ৯৫ টাকায় উঠে গেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত আন্তব্যাংক লেনদেনে ব্যবহৃত ডলারের দামের চেয়ে আট টাকা বেশি। এই গ্যাপ কমাতে না পারলে হুন্ডির দাপট বাড়তেই থাকবে, ফরমাল চ্যানেলের রেমিট্যান্সে যা ধস নামাবে। সাধু সাবধান!
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে। দেশের আমদানি ব্যয় ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধির পেছনে এটাও বড় কারণ। কিন্তু আমদানি এলসি বেলাগাম গতিতে বাড়ার পেছনে প্রধান কারণ ওভার ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে বিদেশে পুঁজি পাচার বেড়ে যাওয়া।
শ্রীলঙ্কার ‘লঙ্কাকাণ্ড’ দেশটাকে চরম অরাজকতায় ডোবাতে চলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ ছিল শ্রীলঙ্কা। প্রায় শতভাগ জনগণ ছিল শিক্ষিত। দেশটির স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছিল ভারতের কেরালার পর দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। চাল উৎপাদনে শ্রীলঙ্কা ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। মানুষের মাথাপিছু জিডিপি ছিল প্রায় ৪ হাজার ডলার। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা ছিল সবচেয়ে অগ্রগামী। ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধে বিজয়ের পর চীনের ঋণের অর্থে শ্রীলঙ্কা অনেকগুলো স্বল্প-প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করে। এর পাশাপাশি ‘সভরেন বন্ড’ ছেড়ে তারা দেশ-বিদেশের অর্থবাজার থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার ঋণ সংগ্রহ করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করার প্রয়াস চালায়। কিন্তু প্রকল্পগুলো থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে মাহিন্দাসহ রাজাপক্ষে পরিবারের অন্য সদস্যরা কোটি কোটি ডলার আত্মসাৎ করার অভিযোগ চরম আকার ধারণ করায় ২০১৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাহিন্দা রাজাপক্ষে মাইথ্রিপালা সিরিসেনার কাছে পরাজিত হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন।
কিন্তু সিরিসেনা সরকার মাহিন্দার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলো প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাহিন্দার ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষে অনেকগুলো ‘পপুলিস্ট’ অঙ্গীকারের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার ভোটারদের মন জয় করে আবার বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হন। ওই নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী গোতাবায়া ১৫ শতাংশ জেনারেল সেলস ট্যাক্সকে ৮ শতাংশে নামিয়ে ফেলেন এবং ২ শতাংশ ন্যাশনাল রিবিল্ডিং ট্যাক্সকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এতে খুশি হয়ে ২০২০ সালের সংসদীয় নির্বাচনে ভোটাররা রাজাপক্ষে পরিবারের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলকে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা সহকারে বিজয় এনে দেয়। মাহিন্দা আবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান, তাঁর সঙ্গে মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন বাসিল রাজাপক্ষে, চামাল রাজাপক্ষে এবং পরবর্তী জেনারেশনের আরও দুজন রাজাপক্ষে। পরিবারতন্ত্র আর কাকে বলে! কিন্তু, এক দশকের ‘ঋণ করে ঘি খাওয়ার’ নীতি ২০২০ সালেই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে শুরু করে। আয় বাড়াতে ব্যর্থ হয়ে চীনের অর্থে নির্মিত হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দরকে ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছে লিজ দিতে বাধ্য হয় শ্রীলঙ্কা। একই সঙ্গে হাম্বানটোটায় নির্মিত রাজাপক্ষে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটিও একেবারেই স্বল্প-ব্যবহৃত বিমানবন্দর হিসেবে বোঝায় পরিণত হয়।
অন্যদিকে ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি আঘাত হানার পর শ্রীলঙ্কায় মানুষ বেশি মারা না গেলেও অর্থনীতিতে বেশ কয়েকটি মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক আয়ের সবচেয়ে বড় সূত্র পর্যটন খাতের আয় মহামারির ফলে রাতারাতি শূন্যে নেমে আসে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের রেমিট্যান্সে মহামারি-সৃষ্ট ধস, যাতে দেশটির ফরমাল চ্যানেলের রেমিট্যান্স আয়ও প্রায় ৮০ শতাংশ সংকুচিত হয়ে যায়। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, রাতারাতি কৃষি খাতে ‘অরগানিক ফার্মিং’ চালুর জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক আমদানি নিষিদ্ধ করে প্রদত্ত প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত, যার ফলে এক অভূতপূর্ব ফলন-বিপর্যয়ে পতিত হয় শ্রীলঙ্কার কৃষি খাত। ফলে শ্রীলঙ্কার কৃষিজাত খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এক বছরে বিপর্যয়করভাবে এক-তৃতীয়াংশ কমে যায়, এবং খাদ্যশস্য আমদানির জন্য ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কাকে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়। এসব বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালেই শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমে বিপজ্জনক স্তরে চলে আসে। আমদানি করতে অসমর্থ হওয়ায় জ্বালানি তেল, এলএনজি, ভোজ্যতেল, চিনি, চাল এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি চরম আকার ধারণ করে, মানুষ রাস্তায় নেমে আসে রাজাপক্ষে পরিবারের উৎখাতের দাবিতে। ২০২২ সালের এপ্রিলে রিজার্ভ মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলারে নেমে যাওয়ায় শ্রীলঙ্কা নিজেকে ঋণখেলাপি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। শ্রীলঙ্কার মতো একদা-সমৃদ্ধ একটা অর্থনীতি যে এভাবে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে, সেটাই অচিন্তনীয় ছিল দুই মাস আগেও। অথচ বিশ্বকে এই অবিশ্বাস্য পতন প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে এখন। অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত জনগণ এপ্রিল মাসজুড়ে কলম্বোর রাজপথে রাজাপক্ষে পরিবারের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের পদত্যাগের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মাহিন্দা রাজাপক্ষের এক অবিমৃশ্যকারী ‘রাজনৈতিক গুন্ডামির’ কারণে ৯ মে এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন মারাত্মক সংঘাতপূর্ণ গৃহযুদ্ধে পর্যবসিত হলো, যেখানে একজন সংসদ সদস্যসহ আট ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। আন্দোলনের তীব্রতায় প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার পর মাহিন্দা তাঁর সমর্থকদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাসে করে কলম্বোয় নিয়ে আসেন। এই ভাড়াটে গুন্ডারা বিনা উসকানিতে মাসাধিককাল ধরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জনতার ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে ও আরও বহু মানুষকে মারাত্মকভাবে আহত করে। এই হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার মানুষ ঘটনাস্থলে ছুটে আসে এবং গুন্ডাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এর জেরে সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীরা সরকার-সমর্থকদের গণপিটুনি দেওয়ার পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং রাজাপক্ষে পরিবারের বাড়িঘর আগুনে পোড়ানো শুরু করে দেয় এবং অনেককে মারধরের পাশাপাশি পানিতে চুবানো শুরু করে। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিশিয়াল বাসভবনে জনতা ঢুকে পড়তে উদ্যত হলে মাহিন্দা এবং তাঁর পরিবার হেলিকপ্টারে চড়ে সেখান থেকে ভেগে গিয়ে ত্রিনকোমালির একটি নৌঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়। এখন গোতাবায়ার যাওয়ার পালা।
শ্রীলঙ্কার এই চলমান গণ-অভ্যুত্থান থেকে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর জন্য অনেকগুলো শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও খামখেয়ালিপনা, পারিবারিক একনায়কতন্ত্র, হঠকারী সিদ্ধান্ত এবং অর্থনৈতিকভাবে অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজাপক্ষে পরিবার দুই বছরের মধ্যেই শ্রীলঙ্কার মতো একটি সমৃদ্ধ অর্থনীতিকে ধসিয়ে দিয়েছে এবং দেউলিয়া করে ফেলেছে। ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বেশ কয়েক বছর শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের বেশি হয়েছিল, কিন্তু ‘ঋণ করে ঘি খাওয়ার’ এই নীতি রাজাপক্ষে পরিবারের শাসনকে অবশ্যম্ভাবী পতনের দিকে ধাবিত করেছে এবং শ্রীলঙ্কার জনগণকেও দুর্দশার অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করেছে। করোনাভাইরাস মহামারি এই পতনকে ত্বরান্বিত করেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক মহাসংকটের আলামতগুলো মহামারির বহু আগেই স্পষ্ট দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। নির্বাচিত সরকার হলেই খামখেয়ালি ও স্বেচ্ছাচারিতার লাইসেন্স জনগণ কাউকে দেয় না। বিদেশি ঋণ পাওয়া গেলেই যথার্থ প্রকল্প মূল্যায়ন ব্যতিরেকে কারও ইচ্ছামাফিক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের পরিণাম কখনোই শুভ হয় না। বাংলাদেশেও প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের পরিবর্তে যদি গ্ল্যামারাস ও স্বল্প-প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ অব্যাহত থাকে, তাহলে শ্রীলঙ্কার মতো ঋণগ্রস্ততার ফাঁদে পড়তে বাংলাদেশেরও দেরি হবে না। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২০২২ সালের মে মাসে ৪১ বিলিয়ন ডলার হয়ে গেছে। চলমান মেগা-প্রজেক্টগুলোর ব্যয়ের ধারাবাহিকতায় বৈদেশিক ঋণ ৯১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে বাংলাদেশের আমদানি গত বছরের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বেড়ে গেছে, যেটাকে আসন্ন মহাবিপদের ‘অশনিসংকেত’ আখ্যায়িত করাই সমীচীন। এই গতিতে আমদানি এলসি খোলা অব্যাহত থাকলে ২০২২ সালের ৩০ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের মোট আমদানি ৮২-৮৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। এর মানে, এই অর্থবছরের রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর প্রাক্কলন সত্ত্বেও অর্থবছরের শেষে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমান অর্থবছরে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে যাবে। অতএব, আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে এ বছর প্রায় ১০-১২ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে।
করোনাভাইরাস মহামারির তাণ্ডব কমতে না কমতেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং আগ্রাসন মোকাবিলায় পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তায় ইউক্রেনের মরণপণ প্রতিরোধ সারা বিশ্বকে এক ভয়াবহ যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে নিক্ষেপ করেছে। সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে। দেশের আমদানি ব্যয় ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধির পেছনে এটাও বড় কারণ। কিন্তু আমদানি এলসি বেলাগাম গতিতে বাড়ার পেছনে প্রধান কারণ ওভার ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে বিদেশে পুঁজি পাচার বেড়ে যাওয়া। উপরন্তু করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে হুন্ডি পদ্ধতি বেশ খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছিল চাহিদা এবং সরবরাহ—দুই দিক থেকেই। এখন আবার হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হয়ে উঠেছে। কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ৯৫ টাকায় উঠে গেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত আন্তব্যাংক লেনদেনে ব্যবহৃত ডলারের দামের চেয়ে আট টাকা বেশি। এই গ্যাপ কমাতে না পারলে হুন্ডির দাপট বাড়তেই থাকবে, ফরমাল চ্যানেলের রেমিট্যান্সে যা ধস নামাবে। সাধু সাবধান!
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
‘দুই দিন আগেই বাড়ি থেকে পাথরঘাটায় চলে এসেছি। এখন পুরোনো জাল সেলাই করছি। এক সপ্তাহের বাজারও করে এনেছি। আজ বিকেলে সাগর মোহনায় যাব, গভীর রাত থেকে জাল ফেলব।’ কথাগুলো বলছিলেন বরগুনা সদরের বাইনচটকী এলাকার জেলে হোসেন আলী। গতকাল বুধবার সকালে বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে কথা হয় তাঁর...
১২ জুন ২০২৫ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার পর সীমান্তে আটকে থাকা তৈরি পোশাক, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রাকগুলো ফেরত আনছেন রপ্তানিকারকেরা। তবে যেসব ট্রাক বন্দরে ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলো ভারতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ট্রাক ঢুকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
১৯ মে ২০২৫আধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
০৮ মে ২০২৫পাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
০৮ মে ২০২৫