আবু তাহের খান
পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জীবন ও প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখার আগ্রহ মানুষের চিরন্তন অন্তর্গত স্বভাবসমূহের অন্যতম। আর এ ধরনের স্বভাবের তাড়নাতেই ইবনে বতুতা কিংবা হিউয়েন সাং সুদূর মরক্কো কিংবা চীন দেশ থেকে তৎকালীন দুর্গম পথের বাধা অতিক্রম করে এ উপমহাদেশ এসেছিলেন। অবশ্য এ উপমহাদেশীয় মানুষের মধ্যে ভ্রমণপিপাসা অতীতে কখনোই খুব একটা প্রবল ছিল না। হতে পারে, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এর একটি বড় কারণ। তবে বাঙালির মধ্যে স্বভাবগতভাবেই ঘরকুনো হয়ে থাকার প্রবণতা যে একসময় যথেষ্টই ছিল, তাতে বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্য স্বাধীনতার পর থেকে জীবিকার প্রয়োজনে সারা পৃথিবীতেই বাঙালি এখন এত বিচিত্র স্থানে ও পেশায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে যে, তা দেখে রীতিমতো অবাক হতে হয়। কে জানে, ভবিষ্যতের কোনো এক পর্যায়ে এ অভিবাসী বাঙালির সংখ্যা হয়তো মূল ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যাবে কি না।
বাঙালি এখন জীবিকার প্রয়োজনে যেমনি বিশ্বের দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, তেমনি তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আবার ভ্রমণের নেশায় এ ছোট্ট দেশের ভেতরেই এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এ সামান্য ভূমিতে ১৭ কোটি মানুষের মধ্যকার ১ শতাংশেরই-বা স্বাচ্ছন্দ্যময় ভ্রমণের সুযোগ কোথায়? আর সে ধরনের সুযোগ না থাকার কারণে সারা বছরই এখন পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে অসহনীয় ভিড় লেগে থাকছে। আর সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অধিক হারে মুনাফা লোটার চেষ্টা করতে গিয়ে একশ্রেণির অপরিণামদর্শী পর্যটন ব্যবসায়ী প্রকৃতি ও প্রাণীর এমন সব অপূরণীয় ও সীমাহীন ক্ষতি করছে যে তা এখন সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর সার্বিক পরিবেশকেই প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর খামখেয়ালি, দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতা সে ঝুঁকিকে আরও বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। দায়িত্বহীন-বোধহীন এ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি গোড়া থেকেই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, নীতিমালা ও যৌক্তিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর আওতায় রেখে কাজগুলো পরিচালনা করত, তাহলে পর্যটন ঘিরে আজ পরিবেশের এ বিপন্ন দশা কিছুতেই তৈরি হতো না। বিষয়টিকে বোঝার জন্য কয়েকটি উদাহরণ নিম্নে তুলে ধরা হলো—
সেন্ট মার্টিনের আয়তন ৮ বর্গকিলোমিটার। এ রকম ছোট্ট আয়তনের একটি প্রবালদ্বীপে পর্যটনের ভরা মৌসুমে টেকনাফ থেকে চলাচল করে দৈনিক ৮টি বড় জাহাজ এবং আরও বেশ কিছু স্পিডবোট। সেখানে রয়েছে ২৩৮টি ছোটবড় হোটেল/মোটেল এবং একটি সরকারি ডাকবাংলো। আর বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন (বিপিসি) সেখানে এসব অবকাঠামো থাকার কথা নিজেরাই ব্যাপকভাবে প্রচার করছে, যাতে পর্যটকের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে পরিবেশ মন্ত্রণালয় আজ প্রায় এক দশক ধরে বলে আসছে, অত্যধিক পর্যটকের চাপে সেন্ট মার্টিনের ভৌত অবস্থা ও জীববৈচিত্র্য প্রায় বিপন্ন হওয়ার পথে। এমতাবস্থায় একে রক্ষা করতে হলে সেখানে যত্রতত্র ও অপরিকল্পিতভাবে হোটেল-মোটেল ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ এবং পর্যটকের সংখ্যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু সেটি নিয়ন্ত্রণ করা তো দূরের কথা, দিনে দিনে পরিস্থিতি আরও শিথিলতার দিকে যাচ্ছে, যার সঙ্গে ছোট-বড় লোভী ব্যবসায়ীরা যেমনি রয়েছে, তেমনি রয়েছে স্থানীয় প্রশাসন ও বিপিসির শৈথিল্যপূর্ণ আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি।
৭ অক্টোবর পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সেন্ট মার্টিনে রাত্রিযাপন করতে না দেওয়া ও সেখানে পর্যটকের দৈনিক সংখ্যা বেঁধে দেওয়াসংক্রান্ত নিজ মন্ত্রণালয়ের ইতিপূর্বেকার সিদ্ধান্ত উদ্ধৃত করে বলেন, আগামী নভেম্বর নাগাদ সেসব বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হবে। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এক আন্তমন্ত্রণালয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে পর্যটকেরা রাতে সেন্ট মার্টিনে থাকতে পারবেন না। পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যটকদের জন্য নিবন্ধনব্যবস্থা প্রবর্তন ও তাঁদের সংখ্যা দৈনিক ১ হাজার ২৫০-এ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের পর ইতিমধ্যে ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হওয়ার পরিবর্তে উল্টো সেখানে দ্রুতগতিতে আরও নানা অনাকাঙ্ক্ষিত নতুন অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত থাকা সত্ত্বেও বিপিসির পক্ষ থেকে সেখানে পর্যটক বৃদ্ধির পক্ষে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, যা সত্যি বিস্ময়কর।
সেন্ট মার্টিনের অধঃগামী বিপর্যয়কর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ১৯৯৯ সালে এটিকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (Ecologically Sensitive Area-ESA) হিসেবে ঘোষণা করে। সেন্ট মার্টিনের মতো সারা দেশে সরকার ঘোষিত এরূপ আরও ১২টি ইএসএ রয়েছে, যার মধ্যে সুন্দরবন, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, টেকনাফ সমুদ্রসৈকত, সোনাদিয়া দ্বীপ, হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, মারজাত বাঁওড়, বুড়িগঙ্গা নদী, শীতলক্ষ্যা নদী, বালু নদ, গুলশান-বারিধারা লেক ও জাফলং-ডাউকি নদী। এর সঙ্গে চলনবিল ও হালতি বিলকেও সম্ভবত ইতিমধ্যে এ তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে বা তা হতে যাচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে দেশে মোট ইএসএর সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫টি। এই ১৫টি ইএসএর মধ্যে দু-একটি বাদে বাকি সবই অতি উচ্চহারে পর্যটক আকর্ষণকারী এলাকা, যেগুলো এখন প্রতিদিনই হাজার হাজার পর্যটকের ভিড়ে মুখর থাকছে। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়েই দেশে এখন এমন শত শত পর্যটন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যারা প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার প্রতি বিন্দুমাত্র দৃষ্টি না দিয়ে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পর্যটকদের এসব যাওয়া-আসা ও সেখানে অবস্থানের কারণে সেখানকার প্রকৃতি ও পরিবেশের যে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যেমন কোনো মনোযোগ নেই, তেমনি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্বিকার।
কোনো প্রকার আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিধারণবিহীন এ পর্যটন পরিভ্রমণ ব্যবস্থার আওতায় পর্যটকদের দ্বারা ব্যবহৃত শত শত টন পলিথিন, অন্যান্য বর্জ্য ও নানা ক্ষতিকর অগলিত পদার্থ ওইসব এলাকার পরিবেশ ও প্রাণিকুলকে প্রতিমুহূর্তেই স্থায়ী ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। উপযুক্ত কোনো পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থাও ওইসব এলাকায় প্রায় নেই বললেই চলে। আর এ ধরনের পরিভ্রমণের ফলে চলনবিল, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর ও মারজাত বাঁওড়ের মাছ ও অন্যান্য পাখপাখালি এখন প্রায় নিঃশেষ হতে বসেছে। অত্যধিক মনুষ্য চলাচলের কারণে ভীতি এড়াতে সুন্দরবনের হরিণ, বাঘ ও অন্যান্য প্রাণী বনের ভারতীয় অংশের দিকে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে শিল্পবর্জ্যে আক্রান্ত বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ইত্যাদি নদ-নদীগুলোর পর্যটন আকর্ষণীয়তা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। অথচ এই নদীগুলোই হতে পারত রাজধানী ঢাকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অন্যতম প্রধান উপকরণ, যা পৃথিবীর নদীঘেরা বড় শহরগুলোর অধিকাংশের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। এ অবস্থায় কর্ণফুলী টানেলের মতো মেগা প্রকল্প না করে ঢাকার চারপাশ ঘিরে যে ৪টি নদী আছে, সেগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করে সেসবকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে হাতিরঝিলের মতো সফল প্রকল্প সামনেই রয়েছে। হাতিরঝিলের মতো প্রস্তাবিত নতুন প্রকল্পগুলোর দায়িত্বও তাই সেনাবাহিনীকে প্রদান করা যেতে পারে। কাজটি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে শুরু করে দিতে পারলে ভালো হয়। কারণ, বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাজনৈতিক সরকারের আমলে এ ধরনের কাজ হওয়া প্রায় অসম্ভব।
সৃষ্ট পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র যদি সত্যি সত্যি দেশের উল্লিখিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এলাকাগুলো অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন পরিভ্রমণ ব্যবস্থার হাত থেকে বাঁচাতে চায়, তাহলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ও সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন। আর ওই নীতিমালায় যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে তার মধ্যে রয়েছে স্থানওয়ারি পর্যটন মৌসুম, দিনওয়ারি পর্যটক সংখ্যা, পর্যটনস্থলে অবস্থান সময়, পর্যটনকেন্দ্রে খাবার ও অন্যান্য দোকানের সংখ্যা, প্রতিষ্ঠানওয়ারি সহায়তা কার্যক্রম যথা-নিরাপত্তা, যাতায়াত, অবস্থান, প্রাথমিক চিকিৎসা, স্থানীয় সমন্বয় ইত্যাদি। ওই নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি আনুষঙ্গিক আর যে কাজগুলো করা যেতে পারে সেগুলো হচ্ছে: এক) পর্যটকদের জন্য অনুসরণীয় আচরণ, চলাচল ও অবস্থান নির্দেশিকা প্রণয়ন; দুই) পর্যটন পরিচালনাকারী বেসরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অনুসরণীয় নির্দেশিকা তৈরি; তিন) পর্যটন সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের জন্য অনুসরণীয় নির্দেশিকা প্রণয়ন; চার) বার্ষিক ভিত্তিতে ইসিএসমূহের পরিস্থিতি পর্যালোচনাপূর্বক সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি।
মোটকথা, দেশের পর্যটনশিল্পকে যেমনি ক্রমান্বয়ে জোরদার করতে হবে, তেমনি আবার রক্ষা করতে হবে পর্যটনকেন্দ্রের পরিবেশকেও। পর্যটন ব্যবসা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের একটি নতুন উদীয়মান অর্থনৈতিক খাত। বহু শিক্ষিত তরুণ-তরুণী এখন চাকরির পেছনে না ঘুরে এ ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে এবং এ কাজে অবশ্যই তাঁরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে সমর্থন পাওয়ার দাবিদার। তবে তা কোনোভাবেই দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশকে বিনষ্ট করে নয়। ফলে এ সবকিছুই এমন একটি সমন্বিত নীতিমালার আওতায় করতে হবে, যাতে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি অর্থনীতিও বিকশিত হতে পারে। তবে দেশ, রাষ্ট্র ও জনগণের সামগ্রিক স্বার্থে প্রকৃতি ও পরিবেশকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রাখতে হবে। কারণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ বাঁচলে তবেই কেবল মানুষ ও তার অর্থনীতি বেঁচে থাকতে পারবে।
লেখক: আবু তাহের খান
সাবেক পরিচালক, বিসিক
পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জীবন ও প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখার আগ্রহ মানুষের চিরন্তন অন্তর্গত স্বভাবসমূহের অন্যতম। আর এ ধরনের স্বভাবের তাড়নাতেই ইবনে বতুতা কিংবা হিউয়েন সাং সুদূর মরক্কো কিংবা চীন দেশ থেকে তৎকালীন দুর্গম পথের বাধা অতিক্রম করে এ উপমহাদেশ এসেছিলেন। অবশ্য এ উপমহাদেশীয় মানুষের মধ্যে ভ্রমণপিপাসা অতীতে কখনোই খুব একটা প্রবল ছিল না। হতে পারে, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এর একটি বড় কারণ। তবে বাঙালির মধ্যে স্বভাবগতভাবেই ঘরকুনো হয়ে থাকার প্রবণতা যে একসময় যথেষ্টই ছিল, তাতে বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্য স্বাধীনতার পর থেকে জীবিকার প্রয়োজনে সারা পৃথিবীতেই বাঙালি এখন এত বিচিত্র স্থানে ও পেশায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে যে, তা দেখে রীতিমতো অবাক হতে হয়। কে জানে, ভবিষ্যতের কোনো এক পর্যায়ে এ অভিবাসী বাঙালির সংখ্যা হয়তো মূল ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যাবে কি না।
বাঙালি এখন জীবিকার প্রয়োজনে যেমনি বিশ্বের দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, তেমনি তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আবার ভ্রমণের নেশায় এ ছোট্ট দেশের ভেতরেই এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এ সামান্য ভূমিতে ১৭ কোটি মানুষের মধ্যকার ১ শতাংশেরই-বা স্বাচ্ছন্দ্যময় ভ্রমণের সুযোগ কোথায়? আর সে ধরনের সুযোগ না থাকার কারণে সারা বছরই এখন পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে অসহনীয় ভিড় লেগে থাকছে। আর সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অধিক হারে মুনাফা লোটার চেষ্টা করতে গিয়ে একশ্রেণির অপরিণামদর্শী পর্যটন ব্যবসায়ী প্রকৃতি ও প্রাণীর এমন সব অপূরণীয় ও সীমাহীন ক্ষতি করছে যে তা এখন সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর সার্বিক পরিবেশকেই প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর খামখেয়ালি, দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতা সে ঝুঁকিকে আরও বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। দায়িত্বহীন-বোধহীন এ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি গোড়া থেকেই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, নীতিমালা ও যৌক্তিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর আওতায় রেখে কাজগুলো পরিচালনা করত, তাহলে পর্যটন ঘিরে আজ পরিবেশের এ বিপন্ন দশা কিছুতেই তৈরি হতো না। বিষয়টিকে বোঝার জন্য কয়েকটি উদাহরণ নিম্নে তুলে ধরা হলো—
সেন্ট মার্টিনের আয়তন ৮ বর্গকিলোমিটার। এ রকম ছোট্ট আয়তনের একটি প্রবালদ্বীপে পর্যটনের ভরা মৌসুমে টেকনাফ থেকে চলাচল করে দৈনিক ৮টি বড় জাহাজ এবং আরও বেশ কিছু স্পিডবোট। সেখানে রয়েছে ২৩৮টি ছোটবড় হোটেল/মোটেল এবং একটি সরকারি ডাকবাংলো। আর বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন (বিপিসি) সেখানে এসব অবকাঠামো থাকার কথা নিজেরাই ব্যাপকভাবে প্রচার করছে, যাতে পর্যটকের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে পরিবেশ মন্ত্রণালয় আজ প্রায় এক দশক ধরে বলে আসছে, অত্যধিক পর্যটকের চাপে সেন্ট মার্টিনের ভৌত অবস্থা ও জীববৈচিত্র্য প্রায় বিপন্ন হওয়ার পথে। এমতাবস্থায় একে রক্ষা করতে হলে সেখানে যত্রতত্র ও অপরিকল্পিতভাবে হোটেল-মোটেল ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ এবং পর্যটকের সংখ্যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু সেটি নিয়ন্ত্রণ করা তো দূরের কথা, দিনে দিনে পরিস্থিতি আরও শিথিলতার দিকে যাচ্ছে, যার সঙ্গে ছোট-বড় লোভী ব্যবসায়ীরা যেমনি রয়েছে, তেমনি রয়েছে স্থানীয় প্রশাসন ও বিপিসির শৈথিল্যপূর্ণ আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি।
৭ অক্টোবর পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সেন্ট মার্টিনে রাত্রিযাপন করতে না দেওয়া ও সেখানে পর্যটকের দৈনিক সংখ্যা বেঁধে দেওয়াসংক্রান্ত নিজ মন্ত্রণালয়ের ইতিপূর্বেকার সিদ্ধান্ত উদ্ধৃত করে বলেন, আগামী নভেম্বর নাগাদ সেসব বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হবে। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এক আন্তমন্ত্রণালয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে পর্যটকেরা রাতে সেন্ট মার্টিনে থাকতে পারবেন না। পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যটকদের জন্য নিবন্ধনব্যবস্থা প্রবর্তন ও তাঁদের সংখ্যা দৈনিক ১ হাজার ২৫০-এ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের পর ইতিমধ্যে ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হওয়ার পরিবর্তে উল্টো সেখানে দ্রুতগতিতে আরও নানা অনাকাঙ্ক্ষিত নতুন অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত থাকা সত্ত্বেও বিপিসির পক্ষ থেকে সেখানে পর্যটক বৃদ্ধির পক্ষে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, যা সত্যি বিস্ময়কর।
সেন্ট মার্টিনের অধঃগামী বিপর্যয়কর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ১৯৯৯ সালে এটিকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (Ecologically Sensitive Area-ESA) হিসেবে ঘোষণা করে। সেন্ট মার্টিনের মতো সারা দেশে সরকার ঘোষিত এরূপ আরও ১২টি ইএসএ রয়েছে, যার মধ্যে সুন্দরবন, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, টেকনাফ সমুদ্রসৈকত, সোনাদিয়া দ্বীপ, হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, মারজাত বাঁওড়, বুড়িগঙ্গা নদী, শীতলক্ষ্যা নদী, বালু নদ, গুলশান-বারিধারা লেক ও জাফলং-ডাউকি নদী। এর সঙ্গে চলনবিল ও হালতি বিলকেও সম্ভবত ইতিমধ্যে এ তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে বা তা হতে যাচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে দেশে মোট ইএসএর সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫টি। এই ১৫টি ইএসএর মধ্যে দু-একটি বাদে বাকি সবই অতি উচ্চহারে পর্যটক আকর্ষণকারী এলাকা, যেগুলো এখন প্রতিদিনই হাজার হাজার পর্যটকের ভিড়ে মুখর থাকছে। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়েই দেশে এখন এমন শত শত পর্যটন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যারা প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার প্রতি বিন্দুমাত্র দৃষ্টি না দিয়ে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পর্যটকদের এসব যাওয়া-আসা ও সেখানে অবস্থানের কারণে সেখানকার প্রকৃতি ও পরিবেশের যে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যেমন কোনো মনোযোগ নেই, তেমনি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্বিকার।
কোনো প্রকার আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিধারণবিহীন এ পর্যটন পরিভ্রমণ ব্যবস্থার আওতায় পর্যটকদের দ্বারা ব্যবহৃত শত শত টন পলিথিন, অন্যান্য বর্জ্য ও নানা ক্ষতিকর অগলিত পদার্থ ওইসব এলাকার পরিবেশ ও প্রাণিকুলকে প্রতিমুহূর্তেই স্থায়ী ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। উপযুক্ত কোনো পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থাও ওইসব এলাকায় প্রায় নেই বললেই চলে। আর এ ধরনের পরিভ্রমণের ফলে চলনবিল, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর ও মারজাত বাঁওড়ের মাছ ও অন্যান্য পাখপাখালি এখন প্রায় নিঃশেষ হতে বসেছে। অত্যধিক মনুষ্য চলাচলের কারণে ভীতি এড়াতে সুন্দরবনের হরিণ, বাঘ ও অন্যান্য প্রাণী বনের ভারতীয় অংশের দিকে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে শিল্পবর্জ্যে আক্রান্ত বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ইত্যাদি নদ-নদীগুলোর পর্যটন আকর্ষণীয়তা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। অথচ এই নদীগুলোই হতে পারত রাজধানী ঢাকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অন্যতম প্রধান উপকরণ, যা পৃথিবীর নদীঘেরা বড় শহরগুলোর অধিকাংশের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। এ অবস্থায় কর্ণফুলী টানেলের মতো মেগা প্রকল্প না করে ঢাকার চারপাশ ঘিরে যে ৪টি নদী আছে, সেগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করে সেসবকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে হাতিরঝিলের মতো সফল প্রকল্প সামনেই রয়েছে। হাতিরঝিলের মতো প্রস্তাবিত নতুন প্রকল্পগুলোর দায়িত্বও তাই সেনাবাহিনীকে প্রদান করা যেতে পারে। কাজটি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে শুরু করে দিতে পারলে ভালো হয়। কারণ, বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাজনৈতিক সরকারের আমলে এ ধরনের কাজ হওয়া প্রায় অসম্ভব।
সৃষ্ট পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র যদি সত্যি সত্যি দেশের উল্লিখিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এলাকাগুলো অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন পরিভ্রমণ ব্যবস্থার হাত থেকে বাঁচাতে চায়, তাহলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ও সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন। আর ওই নীতিমালায় যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে তার মধ্যে রয়েছে স্থানওয়ারি পর্যটন মৌসুম, দিনওয়ারি পর্যটক সংখ্যা, পর্যটনস্থলে অবস্থান সময়, পর্যটনকেন্দ্রে খাবার ও অন্যান্য দোকানের সংখ্যা, প্রতিষ্ঠানওয়ারি সহায়তা কার্যক্রম যথা-নিরাপত্তা, যাতায়াত, অবস্থান, প্রাথমিক চিকিৎসা, স্থানীয় সমন্বয় ইত্যাদি। ওই নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি আনুষঙ্গিক আর যে কাজগুলো করা যেতে পারে সেগুলো হচ্ছে: এক) পর্যটকদের জন্য অনুসরণীয় আচরণ, চলাচল ও অবস্থান নির্দেশিকা প্রণয়ন; দুই) পর্যটন পরিচালনাকারী বেসরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অনুসরণীয় নির্দেশিকা তৈরি; তিন) পর্যটন সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের জন্য অনুসরণীয় নির্দেশিকা প্রণয়ন; চার) বার্ষিক ভিত্তিতে ইসিএসমূহের পরিস্থিতি পর্যালোচনাপূর্বক সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি।
মোটকথা, দেশের পর্যটনশিল্পকে যেমনি ক্রমান্বয়ে জোরদার করতে হবে, তেমনি আবার রক্ষা করতে হবে পর্যটনকেন্দ্রের পরিবেশকেও। পর্যটন ব্যবসা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের একটি নতুন উদীয়মান অর্থনৈতিক খাত। বহু শিক্ষিত তরুণ-তরুণী এখন চাকরির পেছনে না ঘুরে এ ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে এবং এ কাজে অবশ্যই তাঁরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে সমর্থন পাওয়ার দাবিদার। তবে তা কোনোভাবেই দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশকে বিনষ্ট করে নয়। ফলে এ সবকিছুই এমন একটি সমন্বিত নীতিমালার আওতায় করতে হবে, যাতে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি অর্থনীতিও বিকশিত হতে পারে। তবে দেশ, রাষ্ট্র ও জনগণের সামগ্রিক স্বার্থে প্রকৃতি ও পরিবেশকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রাখতে হবে। কারণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ বাঁচলে তবেই কেবল মানুষ ও তার অর্থনীতি বেঁচে থাকতে পারবে।
লেখক: আবু তাহের খান
সাবেক পরিচালক, বিসিক
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫বিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪