Ajker Patrika

নাটকের জয়রথ: ৫০ বছর

মামুনুর রশীদ
নাটকের জয়রথ: ৫০ বছর

মুক্তিযুদ্ধের পরে একুশে ফেব্রুয়ারির পঞ্চাশ বছর সমাপ্ত হলো এবার, একান্ন বছরে পড়েছে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি কেমন ছিল? স্বাধীনতার আনন্দ-বেদনা-অশ্রু—সবকিছু এসে মিশেছিল সেই ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ২৫ মার্চের রাতে ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে পাকিস্তানিরা একুশের মিনারকে ভেঙে দিয়ে সেখানে ভেবেছিল একটি মসজিদ হবে। পুরো নয় মাসে ওখানে মসজিদ করতে পারেনি, কিন্তু ধ্বংসযজ্ঞটা অটুট রেখেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল এই মিনারগুলোই বাঙালির সব আন্দোলন এবং আকাঙ্ক্ষার প্রেরণাভূমি।

১৯৭২ সালে একুশের ভোরে সারা দেশেই প্রভাতফেরি এবং নানা আয়োজনের মধ্য দিয়েই সেটা শুরু হয়েছিল। আজকের মতো বইমেলা তখন গড়ে ওঠেনি, কিন্তু সেই একুশের চেতনা মানুষের স্বপ্ন সাধের মধ্য দিয়ে উদ্‌যাপিত হয়েছিল। সেই সময়ে ছোটখাটো অনেক অনেক একুশের সংকলন প্রকাশ হয়েছিল। সেই সব লেখা এখন গবেষণার বিষয়।

একুশের চেতনায় আলোকিত হয়েছিল শিল্প-সাহিত্য। তার একটি বড় ক্ষেত্র তৈরি হলো—নাট্যশিল্পে। মুক্তিযুদ্ধের আগে এ দেশে নাট্যচর্চা ছিল অনিয়মিত। পাকিস্তানি শাসকদের কাছে রবীন্দ্রনাথ একটা বড় শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে একটা বড় আক্রমণের বিষয় ছিল এ দেশের অনিয়মিত নাট্যচর্চা। যদিও সাতচল্লিশ সালের পর একটা নিয়মিত নাট্যচর্চার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, শিল্প সংকোচনের ফলে তা বেশি দূর এগোতে পারেনি।

একটা কড়া সেন্সর প্রথা আরোপ করেছিল নাটকের ওপর, আর এ দায়িত্ব দেওয়া ছিল পুলিশ বাহিনীর অধস্তন কর্মচারীর ওপর। এরা নাটক সেন্সর করত এবং যেসব ক্লাব নাট্যাভিনয়ের জন্য নাটকের বই বা পাণ্ডুলিপি জমা দিত, তা দেখার ভার ছিল পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের একজন কর্মচারীর ওপর। খুব অবহেলায় এই বই বা পাণ্ডুলিপিটি তারা ফেলে রাখত। এমনও হয়েছে যে রাতে নাটক অভিনীত হবে, সন্ধ্যাবেলায় পাণ্ডুলিপিটি কেটেকুটে অভিনয়ের অনুমতি দেওয়া হতো। সেই সঙ্গে দেখা হতো সেই রাতটি জ্যোৎস্নালোকিত রাত কি না এবং আরেকটি অনুমতি প্রয়োজন হতো তা হলো, মাইক ব্যবহার। অবশ্য স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা এটা মানতেন না।

সব সময়ই মানুষের আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটে শিল্প-সাহিত্যে। তাই দেখা যায় ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে জেলখানায় কারাবন্দী মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকটি অভিনীত হয়। হারিকেনের স্বল্পালোকে কয়েদিদের দিয়ে তিনি নাটকটি অভিনয় করান। যদিও নাটকটি মৌলিক নয়, কিন্তু এমনভাবে তিনি নাটকটি রচনা করেছিলেন, যা পূর্ব বাংলার পরিপ্রেক্ষিতে মৌলিক বলেই বিবেচিত হতো। এখনো সেই নাটক অভিনীত হয়।

এবারে এ দেশের নাট্যচর্চার পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। আরণ্যক নাট্যদলের জন্ম ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। সেই সঙ্গে নাট্যচক্রেরও জন্ম এই সালেই। থিয়েটার, নাগরিকসহ বেশ কিছু নাট্যদলেরও পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। অনেকেই পঞ্চাশ বছর পূর্তি উৎসব করছে। বাইশ বছর হলো অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন উঠে গেছে। এর আগেই তা নানাভাবে শিথিল হয়েছে এবং ১৯৮৫ সাল থেকে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন সেন্সরবিহীন নাটক করে আসছে।

বাংলাদেশের সামরিক শাসকেরা দু-চারবার আইনটি প্রয়োগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এবারে আরণ্যকের নাট্য উৎসবে তাদের প্রযোজিত অনেক মঞ্চনাটক, পথনাটকের মধ্যে মাত্র নয়টি মৌলিক নাটক নিয়ে উৎসব সমাপ্ত করেছে। এর আগে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় পাঁচজন তরুণ নির্দেশকের দ্বারা পাঁচটি নতুন নাটকের উৎসব সমাপ্ত করেছে এবং পরে থিয়েটার অন্যান্য দলের বাইশটি নাটক নিয়ে আরও একটি নাট্য উৎসব শুরু করেছে। এর মধ্যে একটিমাত্র থিয়েটারের। যদিও থিয়েটার খণ্ডিত মমতাজ উদদীন আহমেদের অংশ। এ ছাড়া বাংলাদেশে এখন শত শত নাটক মঞ্চায়িত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

এটা স্বাধীনতার এক সুবর্ণ ফসল। পরাধীন দেশে এই শিল্প বিকশিত হতে পারেনি। যদিও এ বছর সাধারণ রঙ্গালয়ের দেড় শ বছর পূর্তি হচ্ছে। পরাধীন ভারতবর্ষের কলকাতায় ১৮৭২ সালে এই নাট্যযাত্রার শুরু, যখন জমিদারের বাগানবাড়ি, উন্মুক্ত স্থান থেকে নাগরিকদের জন্য নাট্যচর্চার সূচনা হয়, যেখানে টিকিটের বিনিময়ে নাটক অভিনীত হতে থাকে। একেবারে শুরুতেই এই রঙ্গালয়ের উদ্বোধন হয় ‘নীল দর্পণ’ নাটক নিয়ে। ইংরেজ নীলকরদের নিষ্ঠুরতার দলিল নীল দর্পণ। এই নাটক পড়লে বা দেখলে সেই সব নির্যাতনের চিত্র স্মরণ করে গা শিউরে ওঠে। সৌভাগ্যের বিষয়, দীনবন্ধু মিত্রের সেই নাটকটি প্রথম মুদ্রিত ও অভিনীত হয় ঢাকা শহরে যথাক্রমে ১৮৬০ ও ১৮৬১ সালে। এই ঢাকা শহরেই পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি নামে একটি মঞ্চও অল্প কয়েক বছরের জন্য বেঁচে ছিল।

যা-ই হোক, এই যে বাংলাদেশে পঞ্চাশ বছর ধরে এত শত শত নাটক অভিনীত হলো, তার একটা বড় কারণ হলো মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা। দেশ স্বাধীন হলেও শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ঘাপটি মেরে ছিল সেই নিয়ন্ত্রণকামী একদল দুর্বৃত্ত। যারা নাটককে বেশি দূর এগোতে দেয়নি। এর মধ্যে ছিল বেশ কিছু পাকিস্তানি আমলা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রথম সরকার নাটকের ওপর প্রমোদ কর উঠিয়ে দেয়। কিন্তু দেখা গেল কিছু আমলা এটাকে পুনরায় প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন। মনে পড়ে, আমরা কাগজপত্র নিয়ে অফিস-আদালতে ছোটাছুটি করে বিষয়টির একটি সুরাহা করতে সক্ষম হয়েছিলাম। এরপর আমাদের দীর্ঘ সময় ধরে কোনো নাট্যমঞ্চও ছিল না। মহিলা সমিতি এবং গাইড হাউসের অপরিসর মঞ্চে নাটকের অভিনয় করেছি এবং ঢাকার বাইরেও একই ঘটনা ঘটেছে। আমলাতন্ত্রের একক সিদ্ধান্তে বিভিন্ন জায়গায় শিল্পকলা একাডেমি মঞ্চ নির্মাণ করলেও সেগুলো অভিনয় উপযোগী হয়নি, রাজনৈতিক দলের সভা-সমিতির স্থান হয়ে গেছে।

গত শতাব্দীর শেষে ঢাকার কেন্দ্রস্থলে দুটি মঞ্চ নির্মিত হয়, কিন্তু ঢাকার বাইরে এ ধরনের মঞ্চ আর নির্মিত হয়নি। বহু অর্থ ব্যয়ে মহানগর মঞ্চটি বিশাল জায়গা নিয়ে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে নির্মিত হলেও সেখানে অভিনয় করার কোনো সুযোগ তৈরি হলো না। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মেয়র বলেছিলেন, মঞ্চটি যাঁরা ব্যবহার করবেন তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই তা নির্মিত হবে। প্রচুর অর্থ ব্যয়ে মঞ্চটি নির্মাণ করার পর দেখা গেল তা একেবারেই অভিনয় উপযোগী নয়। পুরান ঢাকায় সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে জহির রায়হান মঞ্চ নামে একটি মঞ্চ নির্মিত হলো, কিন্তু ব্যবস্থাপনার প্রবল অবহেলার কারণে দু-চারটি নাট্য উৎসব হলেও তা আর অভিনয় উপযোগী থাকল না। সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা হয়েছিল যে কমিউনিটি সেন্টারগুলো শুধু বিয়েবাড়ির কাজে ব্যবহার করা হয়, সেগুলোকেও নাট্যমঞ্চ হিসেবে দাঁড় করানো যায় কি না। দু-চারবার সে প্রচেষ্টা হলেও শেষ পর্যন্ত এটি আর কার্যকর হয়নি।

তারপর আছে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা। একবার নাটকের সমস্যাগুলো নিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এক সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। আলোচনার একপর্যায়ে তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘প্রায়োরিটির দিক থেকে আপনাদের এই নাচ, গান, নাটক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে খাদ্য। খাদ্য আমদানি করতে হয় তার জন্য টাকা লাগে, সেই টাকা কি আমরা নাচ, গান, নাটকের কাজে ব্যবহার করব?’ আমরা আমাদের যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে দুটিরই প্রয়োজন আছে। তবে মানুষ যদি সংস্কৃতিমান হয় তাহলে সে খাদ্যের প্রয়োজন মেটানোর পথ খুঁজে নেবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এসেছে সংস্কৃতি থেকে, সেই সংস্কৃতি রাজনীতির সঙ্গে মিলেমিশে একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিল। তখন ফুড ফর ওয়ার্কস নিয়ে কিছু লেখালেখিও করেছিলাম। পশ্চিমা দেশগুলো কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালু করে তৃতীয় বিশ্বের মানুষগুলোকে প্রাণিজগতের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। মানুষ কি শুধুই খাবে? তার আর কোনো প্রয়োজন নেই? এখনো দুঃখজনক যে ফুড ফর ওয়ার্কসের বাংলা করে তার নাম দেওয়া হয়েছে কাবিখা। সাধারণ শ্রমিকেরা কাজ করেন। একজন শ্রমিক কিছু চাল নিয়ে ঘরে ফিরবেন, অনাহারী প্রাণীরা কিছু খাদ্য পাবে, কিন্তু তার সঙ্গে আর কিছুর প্রয়োজন নেই? এ নিয়ে বেশ কিছু নাটকেও আমরা সেই সময় অভিনয় করেছিলাম।

সংস্কৃতি না থাকলে কী হয়, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপন। সড়কে প্রতিদিন মানুষ মরছে দুর্ঘটনায়। চালকটির মধ্যে যদি রাস্তা ব্যবহারের সংস্কৃতি থাকত, তাহলে এ ধরনের মৃত্যু কখনোই সম্ভব হতো না। দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে যদি সংস্কৃতির চেতনা থাকত, তাহলে সমাজটা দুর্নীতিতে ভরে যেত না। একটি নাটক, সিনেমা বা গান শুনে যদি মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করত, তাহলে দেশটা আরও সুন্দর হতে পারত। মুক্তিযোদ্ধাদের বা তারও আগে যে সম্পর্ক তাদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল, তার একটা সুন্দর জীবন রচনাকে অনুপ্রাণিত করতে পারত। সংস্কৃতিকে অবহেলার কারণে আজকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি নেন। শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষে না পড়িয়ে কোচিংয়ের মতো একটি ব্যবস্থা করে শিক্ষাকে ধ্বংস করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈরাজ্য চলছে, অথচ একদা খুব অল্প বেতনে শিক্ষকেরা শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় বড় অবদান রেখেছেন। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার আলোকে কীভাবে সমুন্নত রেখেছিলেন।

১৮৭৮ সালে যখন নাটকের শিল্পীদের সমাজ উপেক্ষা করছিল, তখন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেন, নাটকে লোকশিক্ষা হয়। বাংলাদেশের উন্নত সংস্কৃতিকে লোকশিক্ষার কাজে খুব সহজেই ব্যবহার করা যেত। কিন্তু এ ভাবনা কারও কারও মধ্যে থাকলেও অর্থের পেছনে দৌড়ানো রাজনীতিক ও আমলাদের দুর্নীতি করার একটা বড় জায়গা তাঁরা খুঁজে নিয়েছেন শিক্ষায়। সংস্কৃতিকে অবহেলার কারণে সব ধরনের ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছে, অথচ খুব বেশি অর্থও যে প্রয়োজন হয়, তা নয়। এক কিলোমিটার হাইওয়ে তৈরিতে যে ব্যয় হয়, তার সমান অর্থ দিয়ে একটি ভালো মঞ্চ নির্মাণ করা যায়। ঠিক সেই ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের চেয়ে কম টাকা দিয়ে হাজার হাজার নাট্যকর্মীর জীবনধারণের উপায় করা যায়।

জানি, এসব বলে কোনো লাভ নেই। তবু শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা যদি একটুখানি ভাবেন, তাহলে একদিন না একদিন কাজটা হবেই। তবে নাটকের কোনো রথ উল্টো দিকে যাবে না, সেটা সামনের দিকেই এগিয়ে যাবেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আলাস্কা বৈঠকে পুতিনের দেহরক্ষীর হাতে ‘মলমূত্রবাহী স্যুটকেস’ কেন

সিলেটের ডিসি হলেন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে শাস্তি পাওয়া সারওয়ার আলম

শেখ মুজিবকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ছাত্রদল নেতার পোস্ট, শোকজ পেয়ে নিলেন অব্যাহতি

অপারেশন সিঁদুরে নিহত প্রায় দেড় শ সেনার তালিকা প্রকাশ করে মুছে ফেলল পাকিস্তানি টিভি

আমরা দখল করি লঞ্চঘাট-বাসস্ট্যান্ড, জামায়াত করে বিশ্ববিদ্যালয়: আলতাফ হোসেন চৌধুরী

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত