Ajker Patrika

চাকরি ছেড়েছি, শহর ছেড়েছি, অভিনয়টাই করে যেতে চাই শেষ পর্যন্ত

আপডেট : ০৯ মে ২০২৩, ১৪: ৩০
চাকরি ছেড়েছি, শহর ছেড়েছি, অভিনয়টাই করে যেতে চাই শেষ পর্যন্ত

ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ সিরিজটি এখন দর্শকপ্রিয়তার তুঙ্গে। সেই সূত্র ধরে কথা হলো সিরিজের অন্যতম দুই অভিনেতা নাসির উদ্দিন খানরফিউল কাদের রুবেলের সঙ্গে। বাস্তবজীবনেও তাঁরা দুজন ভালো বন্ধু। তাঁরা বলেছেন অভিনয়ের কথা, অভিনয়ের জন্য নিজেদের চেষ্টা আর আত্মত্যাগের কথা, বলেছেন ব্যক্তিগত জীবনের নানা প্রসঙ্গ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এস রানা

মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ এখন জনপ্রিয় একটি সিরিজ। এই জনপ্রিয়তা আপনাদের জীবনে কতটা পরিবর্তন এনেছে?

নাসির উদ্দিন খান: আমার জীবনযাত্রায় তেমন কোনো পরিবর্তন মনে হচ্ছে না। আমি বাসাতেই থাকি, খুব একটা বের হই না। ফলে খ্যাতির যে বিড়ম্বনা, সেটা আমার জীবনে প্রভাব ফেলছে না।

রফিউল কাদের রুবেল: আমি একটা নতুন অনুভূতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। আগে নিজের মতো করে সময় কাটাতে পারতাম। এখন কিছুটা হলেও ব্যাহত হচ্ছে।

দুই বন্ধুকে দিয়ে সিরিজ শুরু, আবার দুই বন্ধুকে দিয়েই শেষ—বাস্তবেও তো আপনার ভালো বন্ধু। এই বন্ধুত্বের শুরু কীভাবে?

রুবেল: ২০০০ সালের জানুয়ারিতে আমি যখন তীর্যক নাট্যগোষ্ঠীতে যোগ দিই, তখন নাসির ভাইকে সিনিয়র হিসেবে পাই। একটা পর্যায়ে আমাদের বন্ডিংটা এমন হয় যে সুসময়-দুঃসময়—সব সময়ই তাঁর পরামর্শ পেয়েছি। এই জায়গা থেকে বন্ধুত্বটা শুধু বন্ধুত্বে নয়, ভাই-গার্ডিয়ান—সবকিছুর মধ্যে আটকে গেছে। 

নাসির: রুবেল আগে থেকেই থিয়েটার করত। যখন তীর্যকে যোগ দিল, তখন আমরা একটা পরিবারের মতো হয়ে যাই। দিন দিন সম্পর্ক গভীর হয়। সম্পর্কের যে গভীরতা, এটা আমার কাছ থেকে সে যেমন পেয়েছে, তার কাছ থেকেও আমি পেয়েছি।

আপনাদের দুজনকেই কেন বন্ধু হিসেবে সিলেক্ট করা হলো এই সিরিজে? বন্ধুত্বের কারণে? নাকি দুজনেই চট্টগ্রামের ভাষায় দক্ষ বলে?

নাসির: যেহেতু এটা স্পিনঅফ সিরিজ, অ্যালেন স্বপন তো আগে থেকেই ছিল, রুবেল নতুন যুক্ত হয়েছে বদু হিসেবে, অ্যালেন স্বপনের বন্ধু হিসেবে। বদু বলেন, জাদু বলেন, প্রতিটি চরিত্রকে ডিরেক্টর তাঁর টিম নিয়ে দীর্ঘদিন সার্চ করেছেন, তারপর কাস্ট করেছেন। ভাষাগত যে দিকটা বললেন, সেটা একটা বিষয়; তবে ডিরেক্টর যেটা বলেছেন, মূল হলো অ্যাক্টিং। রুবেল ভালো একজন অ্যাক্টর।

নাসির উদ্দিন খান। ছবি: জাহিদুল ইসলামআপনার (নাসির উদ্দিন খান) সংলাপে চট্টগ্রামের টান থেকে যায়, যেমন ‘ফ্রাইডে’ সিরিজে আপনি ঢাকার চরিত্র হলেও সেখানে চট্টগ্রামের টান ছিল। আঞ্চলিকতার এই টানটা অভিনয়ে প্রতিবন্ধকতা কি না?

নাসির: যেকোনো অঞ্চলের ভাষা যদি অন্য অঞ্চলের ভাষার মধ্যে এসে যায়, তাহলে কিছুটা সমস্যা তো হয়ই। ফ্রাইডের মধ্যে এমন কিছু অ্যাকসেন্ট এসেছে। এটা আসলে আমাদের ডাবিংয়ের ঘাটতির জন্যই হয়েছে। আঞ্চলিকতা মানুষের মধ্যে থাকতেই পারে, তাই একজন অভিনেতার অবশ্যই এ বিষয়ে কাজ করা উচিত, অনুশীলন করা উচিত। আমারও কিছু সমস্যা আছে, এ নিয়ে আমি আগেও কাজ করেছি, এখনো করছি।

অভিনেতা হিসেবে অ্যালেন স্বপন সিরিজে কার অভিনয় ভালো লাগল?

নাসির: জাদু চরিত্রের অভিনয়।

রুবেল: অ্যালেন স্বপন চরিত্রের নাসির উদ্দিন খান।

নিজের অভিনয়ের কোন দিকটা আরও ভালো করা যেত? বা কোনো দুর্বলতা চোখে পড়েছে কি না?

রুবেল: আলোচনায় বসে ডিরেক্টর যখন বললেন, বদু চরিত্রের ডিজাইনটা কেমন হবে? আমি বললাম, মানুষটা সারা জীবন মারামারি কাটাকাটি করে ৪০০ কোটি টাকা জমিয়েছে, সেই টাকা তার চলে গেছে, সে তো পুরা পাগল! তার ওপর সেই টাকা থেকে কয়েক কোটি টাকা বিশেষ কাউকে না দিলে লোকটার নাম হিটলিস্টে তুলে দিচ্ছে। তার মানে টাকাটা মাফ করে দিলেও তার মৃত্যুর ভয় আছে। আমি যখন অভিনয় করেছি, পাগলের মতোই করেছি। সেই জায়গা থেকে মনে করি, আমি যে অভিনয়টা করেছি, এর থেকে বাড়তি কিছু দিলে ওভার অ্যাক্টিং হয়ে যেত, আবার কম হলে দর্শক গ্রহণযোগ্যতা হারাত। টেকনিক্যাল বিষয়গুলো বাদ দিলে আমি আমার চরিত্র নির্মাণে মোটামুটি সফল।

নাসির: আমি নিজের প্রতি খুব দুর্বল। এই দুর্বলতার কারণে আমার দুর্বলতাগুলো নিজের চোখে কম ধরা পড়ে। এটা আমার অপারগতা হতে পারে।

শায়লার সঙ্গে অ্যালেন স্বপনের সম্পর্কটা অনেকেই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। এমন একটা বিষয় কি সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে?

নাসির: আসলে ইতিবাচক অনেক ঘটনাও সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, আবার নেতিবাচক অনেক ঘটনা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেমন অ্যালেন স্বপন পরনারীর প্রতি আসক্ত, তাহলে ওটা দেখে কেন আমরা পরনারীর প্রতি আসক্তি শিখব? আমি তো এটাও শিখতে পারি যে পরনারীর প্রতি আসক্তি ঠিক না। কিংবা অ্যালেন স্বপন লোকটা এমন খারাপ যে সে তার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য নিজের অনেক আপনজনকেও হারিয়ে ফেলেছে। এটা দেখে কি আমরা এটাও শিখতে পারি না যে লোভ-লালসা বেশি থাকলে আপন মানুষকেও হারাতে হয়। আসলে এটা মানুষের ওপর ডিপেন্ড করবে, কে কীভাবে নিচ্ছে। এখানে আমরা যে সম্পর্কটা দেখছি, এটা গল্পের প্রয়োজনে রাইটার বা ডিরেক্টর এভাবে ডিজাইন করেছেন। এখানে অ্যালেন স্বপনের যে যমজ ভাই আছে, তার মধ্যে কিন্তু আমরা এ ধরনের কিছু পাইনি। সে তো গালিগালাজ পর্যন্ত করে না।

রুবেল: অ্যালেন স্বপন চরিত্রটাই এমন। একটা নেগেটিভ চরিত্র যখন প্লে করবে, তখন কিছু নেগেটিভ বিষয় তো দেখাতেই হবে। নইলে গল্প দাঁড়ায় না।

সম্পর্কের এই গল্পটা কি সচেতনভাবে এড়ানো যেত না? প্রয়োজন ছিল কি?

নাসির: এখানে এড়ানোর কিছু নেই। সব ভালো মানুষকে এক জায়গায় জড়ো করলে খারাপ মানুষ যে আছে, সেটাই তো জানা যাবে না। আমাদের আশপাশের সবাই কি ভালো মানুষ? নেতিবাচক, ইতিবাচক—সব ধরনের মানুষই আছে। যদি শেখার কথাই বলেন, সবকিছু থেকে কি আমরা শিখি? সরকার আমাদের শেখায় গাছ কাটবেন না, গাছ লাগান। আমরা কি গাছ লাগাই? গাছ কাটা বন্ধ করি? লেখা থাকে ভেঁপু বাজাবেন না, ভেঁপু বাজানো কি বন্ধ থাকে?

রুবেল: সম্পর্কটা এড়িয়ে গেলে গল্পটাই এমন হতো না। বদলে যেত।

নাসির ভাই কি আগে থেকে গান করতেন?

নাসির: থিয়েটারে তো শিল্পের সব মাধ্যম নিয়েই চর্চা হয়। সেখানে রিদম শেখানো হয়, স্কেল শেখানো হয়, গান গাওয়া হয়। আর আমরা বাঙালিরা তো সব সময়ই গান গাই। আড্ডার মাঝেও গান গাই।

সিরিজে একটা গান থাকবে, যেটা আপনিই গাইবেন। সিদ্ধান্তটা কীভাবে হয়েছে? গান তো প্রফেশনাল কোনো শিল্পীকে দিয়েও গাওয়ানো যেত?

নাসির: প্রফেশনাল শিল্পীর গাওয়া আরেকটি গান সিরিজে আছে। এই গানটার ভাবনা আগে থেকে ছিল না। পোস্টের কাজে সন্ধি মিউজিক করতে গিয়ে যখন কয়েক জায়গায় ‘তৈ তৈ তৈ’ শব্দগুলো শুনেছিল, তখন তার মাথায় নাকি সারাক্ষণ শব্দগুলো ঘুরছিল। সে ডিরেক্টরকে বলে, এটা নিয়ে একটা গান করা যায় কি না। পরিচালক বললেন, ঠিক আছে, নাসির ভাইকে দিয়ে প্রথম দুইটা লাইন গাওয়াই, বাকিটা অন্য শিল্পীকে দিয়ে। সন্ধি বলল, না, এটা নাসির ভাই-ই করবেন। এভাবেই হয়ে গেল গানটা। গানের কথা লিখেছে সন্ধি ও ম্যাক্স রহমান। মিউজিক করেছে সন্ধি।

এই গল্পের ধারাবাহিকতায় নতুন সিজন নির্মাণ হচ্ছে?

রুবেল: এটা পরিচালক ভালো বলতে পারবেন, আমরা জানি না। তবে দর্শকপ্রিয়তার কারণে হতেও পারে।

সিন্ডিকেটের গল্প আদনান, জিসাদের ঘিরে। এরপর কেবল অ্যালেন স্বপনকে নিয়ে একটা পুরো সিরিজ। এর নির্দিষ্ট কোনো কারণ আছে কি?

নাসির: আমার মনে হয়, সিন্ডিকেটে অ্যালেন স্বপন চরিত্রটা দর্শকপ্রিয় হয়েছে বলেই এই চরিত্রটির উঠে আসার গল্প নিয়ে নতুন সিজনটা হয়েছে।

দুজনকেই নেতিবাচক চরিত্রে বেশি দেখা যাচ্ছে, এটা কেন?

নাসির: আমি কখনোই নেতিবাচক-ইতিবাচক নিয়ে ভাবি না। যদি দেখি চরিত্রটা নিয়ে কাজ করার জায়গা আছে, আমি চরিত্রটা করি। পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা করি, নিজে নিজে ভাবি, চর্চা করি।

রফিউল কাদের রুবেল। ছবি: জাহিদুল ইসলামরুবেল ভাইয়ের চেহারা তো নায়কের মতো। কিন্তু ‘গুটি’ সিরিজে আপনার অভিনয় দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এমন ইনোসেন্ট একটা মানুষ কীভাবে হঠাৎ এতটা হিংস্র হয়ে ওঠে?

রুবেল: আমি ইতিবাচক চরিত্রও করেছি। আমাকে তো একসময় জাতীয় পুলিশ বানিয়ে ফেলছিল। আমার আরও অনেক চরিত্রের অভিজ্ঞতা আছে, সামনে হয়তো দেখবেন। তবে আমার মনে হয়, নেতিবাচক চরিত্রগুলো অনেক কঠিন। নাসির ভাই কী অবলীলায় সেটা করে যান! আমি ভাগ্যবান, সেটা কিছুটা হলেও করতে পারছি।

শুনেছি অভিনয় ও থিয়েটারের জন্য দুজনই চাকরি ছেড়েছেন?

নাসির: কেবল অভিনয়ের জন্য নয়, আমি যে চাকরিটা করতাম, সেখানে ভালো করতে পারছিলাম না। তাই ভিন্ন একটা জায়গা ট্রাই করতে চেয়েছিলাম।

রুবেল: আমি মার্চেন্ডাইজিং করতাম। ক্রমেই যখন ওপরে দিকে উঠছিলাম, কাজের প্রেশার বাড়ছিল, থিয়েটারেও সময় দিতে পারছিলাম না। কেমন অস্থির লাগতে শুরু করল। একজন এসে বলল, ভাই, ছোট একটা ক্যারেক্টার করে যান। কাজটা করলাম। এই ছোট্ট কাজটা আমাকে নতুন করে ভাবাতে শুরু করল। নাসির ভাইসহ অনেকেই বললেন, তোমার ট্র্যাক চেঞ্জ করা দরকার। আমি একটা বড় ঝুঁকি নিয়ে ফেললাম। চাকরি ছেড়ে পুরোদস্তুর অভিনয়ে মন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

থিয়েটারে সময় দিতে পারছেন?

রুবেল: আমরা যারা থিয়েটার করি, তাদের পক্ষে থিয়েটার ছেড়ে থাকাটা কষ্টের। নাসির ভাই তো এখনো নিয়ম করে চট্টগ্রামে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সময় দেন। এখনো যখন দেখি রুমের বাইরে সব জুতো পরিপাটি হয়ে আছে, কেউ জোরে কথা বলছে না, সবাই রিহার্সালে মনোযোগী, বুঝতে হবে নাসির ভাই এসেছেন। আমি অতটা পারি না।

নাসির: এখন তো ভিজুয়্যালে ব্যস্ততা বেড়েছে। তাই নিয়মিত চট্টগ্রামে গিয়ে সময় দেওয়া একটু কঠিন। তবু চেষ্টা করি।

আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

রুবেল: অভিনয়ের জন্য চাকরি ছেড়েছি, শহর ছেড়েছি, আমার বিকল্প কোনো পথ নেই। অভিনয়টাই করে যেতে চাই শেষ পর্যন্ত। তবে বারোয়ারি হতে চাই না। বেছে বেছে কাজ করতে চাই, অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই।

নাসির: অভিনয় করে যাব। কতটা কী পারব, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। তবে চাকরি যে আর করব না, এটা নিশ্চিত।

নতুন কাজের কথা বলুন।

রুবেল: একটা ওয়েব সিরিজ আর সিনেমা করছি। কিছু বিজ্ঞাপনের কাজ নিয়ে কথা হচ্ছে।

নাসির: নতুন কোনো কাজ এখনো করিনি। কয়েকটা কাজ নিয়ে প্রাথমিক কথা চলছে। শিগগিরই হয়তো চয়নিকা চৌধুরীর ‘প্রহেলিকা’ সিনেমাটি মুক্তি পেতে পারে।

অনেকেই টিভি নাটকে সময় কমিয়ে দিচ্ছেন। আপনারাও দেখছি ওয়েব কনটেন্টেই কাজ করছেন বেশি। এটা কি বাজেট বা সম্মানীর তারতম্যের কারণে হচ্ছে?

রুবেল: আমরা যারা থিয়েটার করি, অভিনয় করে টাকা উপার্জন করব—এমনটা কল্পনাও করিনি। অবশ্যই অর্থ বিষয়টা এখন গুরুত্বপূর্ণ, তবে মুখ্য না। ব্যাটে বলে মিললে অবশ্যই অভিনয় করব।

নাসির: দেখুন বাজেট একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিন্তু অতীব গুরুত্বপূর্ণ না। বাজেট কম হলে সেভাবেই প্রোডাকশন ডিজাইন হবে। কোনো মাধ্যমেই অভিনয় করতে আমার আপত্তি নেই। তবে আমাকে সময় দিতে হবে, চরিত্রটিকে বুঝতে দিতে হবে। হুট করে বললেই তো আর কাজ করা যায় না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত