Ajker Patrika

সুমির দৌড়, সুমির বাঁচা

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৯: ৫৯
সুমির দৌড়, সুমির বাঁচা

আগের দিনে রেডিও-টিভিতে গানের অনুষ্ঠান হতো ‘লাইভ’। কোনো কারণে নির্ধারিত সময়ে শিল্পী স্টুডিওতে পৌঁছাতে না পারলে ঘোষণা দিয়ে বলা হতো, নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে এখন…। পেশাদার সাংবাদিকদেরও সে রকম ঝামেলায় পড়তে হতো। জরুরি অ্যাসাইনমেন্টে কেউ সময়মতো পৌঁছাতে না পারলে হাতের কাছে যাঁকে পাওয়া যেত, তাঁকেই কাজে পাঠাতেন চিফ রিপোর্টার। সিনিয়ররা এসব নিয়ে আপত্তি করতেন, কিন্তু জুনিয়রদের রা কাড়ার উপায় ছিল না। আমরা একে বলতাম ‘প্রক্সি বিট কাভার’। 
সে রকম আমাকেও একদিন প্রক্সি দিতে পাঠানো হলো মহিলা পরিষদের অফিসে। বলা হলো, জামালপুর বা টাঙ্গাইল থেকে এক নারীকে আনা হয়েছে, তাঁর সঙ্গে কথা বলে রিপোর্ট করতে হবে।

মহিলা পরিষদে গিয়ে দেখি, মলিন চেহারার এক কিশোরী চুপচাপ বসে আছে। হাতে কালো রঙের একটি ব্যাগ। পরিষদের এক কর্মকর্তার কাছে পত্রিকার পরিচয় দিতেই তিনি একটি কক্ষে বসতে বললেন। এরপর সেই কিশোরীকে ডেকে আনলেন। শুরু হলো ইন্টারভিউ। এটা ছিল ২০০০ সালের ৯ জুন। ওই কিশোরী সহজে কোনো কথার জবাব দেয় না। যা বলে, তা-ও খুব ছোট করে। বেশির ভাগ কথার জবাবে মাথা একবার ওপর থেকে নিচ করে, আবার ডানে-বামে নাড়ে। মনে হলো, এতে কাজ হবে না। এরপর মেয়েটার পুরো ঘটনা যিনি জানেন, তাঁকে ডেকে দেওয়ার অনুরোধ করলাম। তিনি এসে শোনালেন এই কিশোরীর দুর্বিষহ জীবনের গল্প। অফ বিটের কাজ চাপানো নিয়ে এতক্ষণ চিফ রিপোর্টারের ওপর আমার যে ক্ষোভ ছিল, মুহূর্তে তা উবে গেল। মনে হলো, ভালো একটা নিউজের ভেতরে ঢুকছি।

যে কিশোরী আমার সামনে বসে আছে, তার নাম সুমি। ময়মনসিংহ শহরের সানকিপাড়ার ইসমাইল আলীর মেয়ে। সুমির বয়স যখন দুই মাস, তখন তার মা মারা যান। ইসমাইল আলী আবার বিয়ে করেন। সুমির লালনপালনের দায়িত্ব পড়ে সৎমায়ের ওপর। তিন বছর পর ইসমাইলও মারা যান। এরপর থেকে শুরু হয় সুমির গঞ্জনার জীবন। সৎমা তাকে নানাভাবে নির্যাতন করতে থাকেন। সুযোগ বুঝে সুমি একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। বাসে উঠে সোজা চলে আসে ঢাকায়। রাজধানীর একটি বাসায় কাজও জুটে যায়। কিন্তু সেই সুখ কপালে সয় না।

আলম নামের সুমির এক সৎভাই কীভাবে যেন খোঁজ পেয়ে যায়। একদিন সেই ভাই এসে গৃহকর্তার সামনে হাজির হন। তিনি বোনকে দুধভাতে রাখতে চান। অন্যের বাসায় ঝিয়ের কাজ করতে দেবেন না। গৃহকর্তাও আপত্তি করেন না। সুমি চলে যায় ভাইয়ের হিল্লায়। ঢাকার বাসা থেকে বেরিয়ে সুমি কোনোভাবেই বুঝতে পারেনি, তাকে কোথায় নেওয়া হচ্ছে। সৎভাই আলম তাকে নিয়ে যায় জামালপুরের নান্দিনায় মালেকা বেগমের কাছে। দুদিন সেখানে রেখে এরপর নিয়ে যায় রানীগঞ্জ পতিতালয়ে। সেখানকার টপ টেরর বিশুর কাছে সুমিকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করে চলে গেলেন সৎভাই।

জামালপুরের রানীগঞ্জের এই পতিতালয় তখন খুব জমজমাট। সেখানকার সর্দারনি শেফুকে দেওয়া হয় সুমির দায়িত্ব। তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আদিম ব্যবসায় নামানোর চেষ্টা চলল কয়েক দিন। কিন্তু সুমি নাছোড়। কোনোভাবেই রাজি হয় না। শেফু এতে খেপে যান। তিনি সুমির চুল কেটে তাকে আটকে রাখেন এই পল্লির একটি নির্জন ঘরে। এভাবে কেটে যায় তিন রাত। একদিন ভোরে সুযোগ বুঝে পালিয়ে যায় সুমি।

সুমি সেদিন আমাকে তার দৌড়ানোর গল্প বলেছিল। তা ছিল সাদিয়া সুলতানার গল্প ‘ন আকারে না’-এর তুলির মতো। সুমির মনে হলো, সে দৌড়াচ্ছে না, উড়ছে। ছোটবেলায় পাখি ধরতে অনেক দূর অব্দি দৌড়াত সুমি। সেই দৌড় নিজের জীবন বাঁচাতে কাজে দিল। পা চলছে না, তবু কে যেন কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলছে, বাঁচতে হলে দৌড় দে সুমি, দৌড়া। দৌড় যখন শেষ হলো, তখন দিনের আলো ফুটেছে। জামালপুর শহরের দয়াময়ী রোডের একটি বাড়ির সামনে থেমে যায় সুমি। গৃহকর্তার কাছে বাঁচার আকুতি জানায়। সুমির কপাল ভালো। সেই বাড়িতে থাকতেন জনকণ্ঠের জামালপুর প্রতিনিধি মোস্তফা বাবুল। 

সুমির কথা শুনে তাঁর স্ত্রী তাকে বসতে দেন। পতিতালয়ে তখন জানাজানি হয়ে গেছে। পল্লির ভাড়াটে লোকেরা সুমির খোঁজে চারদিকে বেরিয়ে পড়েছে। বাবুল ফোন করেন নারীপক্ষের জামালপুর অঞ্চলের দুর্বার নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের আহ্বায়িকা শামীম আরাকে। তিনি পুলিশের সাহায্য নিতে পরামর্শ দেন। জামালপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছিলেন মল্লিক ফখরুল ইসলাম। তিনি ঘটনা শুনে রেজাউল ইসলাম খান নামের এক এসআইকে পাঠান। তিনি এসে সুমিকে বাবুলের বাড়ি থেকে নিয়ে যান। কিন্তু অভিযোগের বর্ণনা শুনে পুলিশ মামলা না নিয়ে ৫৪ ধারায় সুমিকে আদালতে পাঠান। ম্যাজিস্ট্রেট নিরাপদ হেফাজতে রাখতে বলেন।

বাবুল তবু থেমে যাননি। তিনি জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করেন বিষয়টি দেখার জন্য। জেলা প্রশাসক একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দেন। তিনি সুমির জবানবন্দি শোনেন। এরপর মামলা নেওয়ার জন্য পুলিশকে আদেশ দেন। পুলিশ বাধ্য হয়ে বিশু, আলম, শেফুকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করে। 
মামলা হলেও মূল আসামিদের গ্রেপ্তার না করায় তারা সুমিকে নিরাপদ হেফাজত থেকে বের করার ফন্দি আঁটতে থাকে। বাবুল যাতে বিপদে পড়েন, সে কারণে সুমির কাছ থেকে উল্টো জবানবন্দি আদায়ের চেষ্টা হয়। কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।

এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হলে বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নজরে পড়ে। তিনি বিষয়টি দেখভালের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশে পাল্টে যায় পরিস্থিতি। মহিলা পরিষদের দুই সদস্যের একটি দল জামালপুরে গিয়ে সুমিকে তাদের কাছে নিয়ে আসে। মহিলা পরিষদের আশ্রয়কেন্দ্র রোকেয়া সদনে ঠাঁই হয় সুমির। পুনর্বাসনের পাশাপাশি সুমির মামলাও দেখভাল করে মহিলা পরিষদ। এত দিনের ঝড়ঝাপটা পেরোনো সুমির জীবন বদলে যায় এরপর। এখন সে ভালোই আছে।

সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতা নিয়ে আজকাল অনেকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। নানা কথা কানে আসে। খবর ও খবরের মানুষের এখন নাকি কোনো দাম নেই। সবই জলের দামে কেনা যায়। কিন্তু এই যে সংবাদপত্রের একটি খবর সুমির মতো মেয়েকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিল, তার কি কোনো মূল্য নেই? হয়তো নেই, হয়তো আছে! সেই সিদ্ধান্তের ভার পাঠকের ওপরই থাকুক। 

আরও পড়ুন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

বগুড়ায় ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা, পাঁচ নেতা-কর্মীকে শোকজ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত