Ajker Patrika

৫০ বছর ধরে কুষ্ঠ হাসপাতালে কিশোরী বালা চাকমা, খোঁজ নেন না কেউ

ঝুলন দত্ত, কাপ্তাই (রাঙামাটি)  প্রতিনিধি
৫০ বছর ধরে কুষ্ঠ হাসপাতালে কিশোরী বালা চাকমা, খোঁজ নেন না কেউ

সোমবার সকাল সাড়ে নয়টা। রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা খ্রীষ্টিয়ান হাসপাতালের অধীনে পরিচালিত চন্দ্রঘোনা কুষ্ঠ হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা মিলল ৩ জন রোগীর। তাদের একজন কিশোরী বালা চাকমা। শতবর্ষী কিশোরী বালা চাকমা অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। দৃষ্টি এবং শ্রবণ শক্তি হারিয়েছেন বহু আগেই। হাসপাতালের ওয়ার্ডে দায়িত্বরত মহিলা স্টাফ উক্রা চাকমা এবং পাখি ত্রিপুরার সহায়তায় কথা বলার চেষ্টা কলেও সব উদ্ধার করা গেল না। অস্পষ্ট গলা। 

কথা বলে এইটুকু বোঝা গেল ৪ ছেলে এবং ৪ মেয়ে কিশোরী বালা চাকমার। স্বামী মারা গেছেন অনেক আগে। বাড়ি রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলায়। তবে গ্রামের নাম জানাতে পারেননি। পরিবারে এখন কে কে আছেন, সেটাও জানেন না।  

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায় এখানে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের কুষ্ঠরোগ নির্মূল হয়েছে। তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় কারও পায়ে ক্ষত, মুখে ক্ষত, নার্ভে সমস্যা রয়ে গেছে। এদের এসব সমস্যার চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

হাসপাতালের স্টাফ পাখি ত্রিপুরা বলেন, ‘আমি ২১ বছর ধরে তাঁকে চিনি, একসময় কুষ্ঠ পাহাড়ের কুষ্ঠ আশ্রমে ছিলেন। পরে এখানে ভর্তি হয়েছেন। শুনেছি তাঁর বাড়ি রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলায়। ৪ ছেলে, ৪ মেয়ে আছে। স্বামী মারা গেছে অনেক বছর আগে। এক সময়  বড় ছেলে দেখতে এলেও এখন কেউ দেখতে আসে না উনাকে। তবে মাঝে মাঝে হাসপাতালে মায়ের জন্য টাকা পাঠান বড় ছেলে। 

একই কথা বললেন হাসপাতালের স্টাফ উক্রা চাকমাও। তিনি বলেন, ‘উনাকে এখন কেউ দেখতে আসেন না। তবে আমরা হাসপাতালের পক্ষ হতে সব সময় যত্ন নিই সব রোগীর।’ 

এ সময় পাশের বেডে থাকা রেজিনা বেগম বলেন, ‘আমার বয়স যখন ১৩, তখন থেকে আমি এই হাসপাতালে আছি। ১৯৮১ সালে আমি যখন প্রথমে এই হাসপাতালে আসি, তখন থেকেই তাঁকে দেখে আসছি।’ 

হাসপাতালের কর্মচারী বিমল সরকার বলেন, ‘আমি স্বাধীনের পর থেকে  তাঁকে এই হাসপাতালে দেখছি, অনেক আগে ছেলেরা দেখতে এলেও এখন কেউ আসে না।’ 

পরিবারের কেউ দেখতে আসেন না কিশোরী বালা চাকমাকে। ছবি: আজকের পত্রিকাকুষ্ঠ হাসপাতালের সহকারী ইনচার্জ রাজেন্দ্র নাথ পাণ্ডে বলেন, ‘আমি যখন ১৯৮৪ সালে এই হাসপাতালে যোগদান করি, তখন থেকে উনাকে মহিলা ওয়ার্ডে দেখতে পাচ্ছি। তবে শুনেছি উনি অনেক আগে কুষ্ঠ পাহাড়ের কুষ্ঠ আশ্রমে ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে এখানে ভর্তি হন। ভর্তিতে ঠিকানা লেখা ছিল কুষ্ঠ আশ্রম। তাই তাঁর স্বামীর বাড়ির ঠিকানা আমাদের এখানে লিপিবদ্ধ নেই। শুনেছি লংগদু উপজেলা থেকে বড় ছেলে একজনের মাধ্যমে টাকা পাঠান। তবে কিশোরী বালা চাকমাকে কেউ দেখতে আসেন না। আমরা হাসপাতালের পক্ষ হতে প্রত্যেক রোগীকে বিনা মূল্যে দুই বেলা  ভাত এবং একবেলা নাশতা দিই। সঙ্গে বিনা মূল্যে ওষুধ, চিকিৎসাসেবা ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপকরণ দিয়ে থাকি।  

কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা খ্রীস্টিয়ান ও কুষ্ঠ হাসপাতালের পরিচালক ডা. প্রবীর খিয়াং বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই কুষ্ঠ রোগীদের বিষয়ে সামাজিক ও পারিবারিক কিছু অন্ধবিশ্বাস‌‌ বা অস্পৃশ্যতা রয়েছে। যার জন্য কুষ্ঠ হাসপাতালে এসে সুস্থ হওয়া অনেক রোগী তাদের নিজের পরিবারের কাছে অথবা সমাজে ফিরে যেতে পারেননি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এসব রোগীদের সব দায়িত্ব বহন করে চলছে। যদিও আগের তুলনায় এখন এসব বিষয়ে অনেক সচেতনতা এসেছে। তবে হাসপাতালে যেসব রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন তাঁদের কুষ্ঠরোগ নির্মূল হয়েছে। কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় কারও পায়ে ক্ষত, মুখে ক্ষত, নার্ভে সমস্যা আছে। এদের এসব সমস্যার চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’

উল্লেখ্য, ১৯১৩ সালে চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনায় অবস্থিত এই কুষ্ঠ হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২০ সাল থেকে তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে কুষ্ঠরোগ ব্যাপকভাবে দেখা দেওয়ায় নেদারল্যান্ডসের আর্থিক সহযোগিতায় হাসপাতালটি পরিসর বাড়ে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার লোক এ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য আসতেন। কুষ্ঠ রোগীদের সমাজে জায়গা না হওয়ায় তাদের একসঙ্গে বসবাসের জন্য চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১১ নম্বর চন্দ্রঘোনা কদমতলী ইউনিয়নে জুম পাড়া কুষ্ঠ পল্লিতে তাঁদের চিকিৎসা দেওয়া হতো। বর্তমানে আর্থিক সংকটের কারণে সেটি বন্ধের পথে।

 এ রোগীদের সমাজে বেঁচে থাকতে হলে সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করছেন চন্দ্রঘোনা কুষ্ঠ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত