Ajker Patrika

শেবাচিম হাসপাতালে যন্ত্রপাতি অচল, সিন্ডিকেটে জিম্মি রোগী

  • আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স পড়ে আছে
  • ১৩টি এক্স-রে মেশিনের ৮টি বিকল
  • ইকোকার্ডিওগ্রাম মেশিন অচল
  • ৫টি আলট্রাসনোগ্রাম মেশিনের ৩টি অচল
  • গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট, সব নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল
আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২৪, ১৫: ৩৬
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বৃহত্তর বরিশালের জনসাধারণের সেবা নেওয়ার অন্যতম প্রতিষ্ঠান শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতাল। তবে হাসপাতালের পাশে গড়ে ওঠা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষায় যেতে বাধ্য করা, নিম্নমানের খাবার, সরকারি অ্যাম্বুলেন্সসেবা না পাওয়ায় ভুগছে রোগীরা। সিন্ডিকেট-বাণিজ্যের কারণে রোগীরা সেখানে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না।

বরিশাল বিভাগের ছয় জেলাসহ সন্দ্বীপ-হাতিয়া, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ একাংশের জনসাধারণ শেবাচিমে চিকিৎসা নেয়। হাজার শয্যার হাসপাতালে প্রতিদিন ভর্তি থাকে গড়ে ১ হাজার ৭০০ রোগী। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয় হাজারের বেশি রোগী। হাসপাতালের প্রতিটি সেক্টর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, চিকিৎসকসহ নগরের অনেক প্রভাবশালী ঠিকাদার এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত।

এদিকে হাসপাতালের সার্বিক তদারকিতে গঠিত হয়েছিল ‘স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা কমিটি’। এই কমিটি এখন অকার্যকর। গত ১৫ জুন নতুন সভাপতি হয়েছেন তৎকালীন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। নানা আশা জোগালেও তিনি হাসপাতালে রোগীর সেবা ফেরাতে পারেননি।

নামে অ্যাম্বুলেন্স

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শেবাচিম হাসপাতালে ৩০টি আইসিইউ শয্যা আছে। কিন্তু নেই ডায়ালাইসিস সুবিধা। হৃদ্‌রোগীদের চিকিৎসায় এনজিওগ্রামের সব ব্যবস্থা আছে, নেই চিকিৎসক। কোটি টাকা মূল্যের রোগনির্ণয় সরঞ্জামগুলো বিকল। আইসিইউ সুবিধার অ্যাম্বুলেন্সও রয়েছে এই হাসপাতালে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ সরকারকে ভারত সরকারের উপহারের ১০৯টি অ্যাম্বুলেন্সের এটি একটি। হাসপাতাল সূত্র বলছে, এটি পড়ে আছে। এখন পর্যন্ত কোনো রোগী এই অ্যাম্বুলেন্সসেবা পায়নি। এ ছাড়া হাসপাতালে আরও চারটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও সেগুলোর সেবা থাকে নামমাত্র। এর বাইরে গড়ে উঠেছে অ্যাম্বুলেন্সের বিশাল বাণিজ্য। শতাধিক অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। শেবাচিম থেকে ১৫৫ কিলোমিটার দূরের রাজধানীতে রোগী বহনে ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট।

বিকল রোগনির্ণয় যন্ত্র

শেবাচিমের দুটি সিটি স্ক্যান মেশিনের একটি পরিত্যক্ত হয়েছে অনেক বছর আগে। হাসপাতালের ৫টি আলট্রাসনোগ্রাম মেশিনের ৩টি অচল ২-৩ বছর ধরে। ১৩টি এক্স-রে মেশিনের মধ্যে বিকল ৮টি। এগুলোর মধ্যে ৫টি এক্স-রে মেশিন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। একমাত্র এমআরআই মেশিনটি বিকল ৭ বছর ধরে। ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে ইকোকার্ডিওগ্রাম মেশিন অচল থাকায় সেবা পাচ্ছেন না হৃদ্‌রোগীরা।

হাসপাতালের ক্যাথল্যাব স্থাপন করা হয় ২০১৪ সালে। সেটি বন্ধ থাকায় মাঝে টানা তিন বছর এনজিওগ্রাম বন্ধ ছিল। সেটি পরিচালনাকারী টেকনিশিয়ান গোলাম মোস্তফা বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ এই মেশিন বারবার সার্ভিসিং করে সচল রাখতে হচ্ছে। যেকোনো সময়ে আবার অচল হয়ে যেতে পারে। ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কোবাল্ট-৬০ মেশিনটি স্থায়ীভাবে অচল।

ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সিন্ডিকেট

হাসপাতালের সামনে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সেখানে রোগী পাঠালে ৪০ শতাংশ হারে কমিশন পান চিকিৎসক। রোগী নেওয়া দালালেরা পান ১০ শতাংশ। হাসপাতাল থেকে প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার দালাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন হাসপাতালের কর্মচারী শহীদ, কালাম মৃধা, মিলন ও ধলা জাফর। রোগীপ্রতি ৪০ শতাংশ কমিশন পান। ৫ ভাই রবিন, কবির, আজিজুল, হাসিব, মিলন এবং তাঁদের এক ভগ্নিপতি হাসপাতালের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য রোগী ভাগিয়ে নেন। প্রতি হাজারে ৩০০ টাকা কমিশন পান তাঁরা।

খাবারের নিম্নমানের

হাসপাতালের খাবারের মান নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তালিকায় অনেক খাবার সরবরাহ করা হয় না। তারপরও নিয়মিত বিল ও যুগের পর যুগ একই ঠিকাদারের ওপরই ভরসা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শেবাচিম হাসপাতালে ৩ বেলা খাবারসহ সব ধরনের কাজের ঠিকদার হলেন চারজন। ৩০ বছরের বেশি সময় তাঁরাই ঠিকাদারি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। চার ঠিকাদার হলেন হাসিব মল্লিক, মরন পিপলাই, আশরাফুল ইসলাম রেজা ও ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মজিবর রহমান। ওষুধ সরবরাহের ঠিকাদারি করেন শাহীন নামের একজন।

এই হাসপাতালে চলতি বছর চিকিৎসা নিয়েছেন বরিশাল নগর উন্নয়ন ফোরামের সদস্যসচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু। তিনি বলেন, তিনি ২৭ এপ্রিল থেকে ১০ মে পর্যন্ত শেবাচিমতে ভর্তি ছিলেন। হাসপাতালটির অব্যবস্থাপনা অবর্ণনীয়। হাসপাতালের সিন্ডিকেট ভাঙাই নতুন পরিচালকের বড় চ্যালেঞ্জ। এর ওপর নির্ভর করবে হাসপাতালে ভবিষ্যৎ সেবার মান।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যা হচ্ছে

গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর হাসপাতালের পরিচালকসহ অনেক চিকিৎসক ও ইন্টার্নদের হাসপাতাল ছাড়তে হয়েছে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর আন্দোলনের মুখে পরিচালক পদত্যাগ করেন। হাসপাতাল সূত্র বলছে, চিকিৎসকের সংখ্যা আগেও কম ছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চিকিৎসকেরা চলে যাওয়ায় সংকট আরও বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে হাসপাতালটির পরিচালক নিযুক্ত হয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মশিউল মুনীর। তিনি এখনো দায়িত্ব নেননি।

তাই হাসপাতালের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করা হয় উপপরিচালক এস এম মনিরুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে। তাঁর মোবাইলে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই বিষয়ে জানতে কল করা হয় হাসপাতালের সহকারী পরিচালক রেজাউল আলম রায়হানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ব্যস্ত আছেন। এ বিষয়ে কথা বলবেন না।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বরিশাল নগর সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, সরকারি হাসপাতালের দামি যন্ত্রপাতিগুলো কেন অচল থাকবে? আসলে কর্মচারীরাই এগুলো অচল করে রোগী বাইরে পাঠায়। তিনি আরও বলেন, যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ করা, ওয়ার্ডগুলোয় সেবা নিশ্চিত করা, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করাই হবে নতুন প্রশাসনের বড় চ্যালেঞ্জ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

বন্ধুকে ছাত্রলীগ সাজিয়ে পুলিশে দিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে ধর্ষণ করলেন ছাত্রদল নেতা

মানিকগঞ্জে রাতের আঁধারে স্থানান্তর করা বিদ্যালয় ভবন পরিদর্শনে কর্মকর্তারা

পরিপাকতন্ত্রের ওষুধের পেছনেই মানুষের ব্যয় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত