Ajker Patrika

কলসকাঠীর জমিদারবাড়ি

জাকির হোসেন তপন
কলসকাঠীর জমিদারবাড়ি

ছোট ভাইকে হত্যার ভয়াবহ ষড়যন্ত্রটা করেছিলেন বড় ভাই। কিন্তু ঘটনাক্রমে সে ষড়যন্ত্রের গল্প জেনে গিয়েছিলেন বড় ভাইয়ের স্ত্রী। তিনি আবার সে খবর জানিয়ে দিয়েছিলেন ছোট ভাইকে। বড় ভাইয়ের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি জানতে পেরে রাতের অন্ধকারে নিজের গ্রাম গারুড়িয়া ছেড়ে মুর্শিদাবাদ চলে যান ছোট ভাই। সেখানে তিনি নবাবের কাছে সব ঘটনা খুলে বলেন। পরে নবাব তাঁকে জমিদার হিসেবে নিয়োগ করেন। জমিদারি পেয়ে ছোট ভাই কলুসকাঠীতে এসে বসতি স্থাপন করেন। এই কলুসকাঠীই ধীরে ধীরে কলসকাঠীতে পরিণত হয়ে যায় লোকমুখে।

ভাইয়ে ভাইয়ে এই হত্যার ষড়যন্ত্রের গল্পের চরিত্রগুলো কলসকাঠীর জমিদারের। জানা যায়, গারুড়িয়ার জমিদার রামাকান্তের দুই পুত্র—রাম বল্লভ ও জানকী বল্লভ রায়চৌধুরী। ১৭০০ সালের গোড়ার দিকে বড় ভাই রাম বল্লভ রায়চৌধুরীর ষড়যন্ত্রের শিকার হন ছোট ভাই জানকী বল্লভ রায়চৌধুরী। পরে তিনিই কলসকাঠী জমিদারবাড়ি স্থাপন করেন। কলসকাঠীর তেরো জমিদার বলতে মূলত বোঝানো হয়, জানকী বল্লভের পরবর্তী বংশধরদের।

এই কিংবদন্তির গল্পের প্রায় ৩২২ বছর পরের একদিন অফিশিয়াল কাজে বরিশালের বাকেরগঞ্জে গিয়েছিলাম। এক সহকর্মীর সঙ্গে সেখান থেকে কলসকাঠী। পথে বেশ প্রাচীন কিছু বাড়ি ও মন্দির চোখে পড়েছিল। বড় একটা পুকুরঘেঁষা প্রাচীন মন্দিরে এখনো পুজো হয় বলে মনে হলো। বাংলাদেশের অনেক গ্রামেই এ রকম পুরোনো বাড়ি ও মন্দির দেখা যায়। তাই একে আলাদা কিছু ভাববার অবকাশ হয়নি। সহকর্মীর কথায় আগ্রহ দেখালাম। এ সময় দেখা হয়ে গেল গোপাল দাসের সঙ্গে। তিনি অদূরেই জমিদারবাড়ির একটা অংশে নিয়ে গেলেন আমাদের।

এই ভবনে এখনো একটি পরিবার বাস করেন।

প্রায় ৩০০ বছরের বেশি পুরোনো এক প্রাসাদসম ভবনের ধ্বংসাবশেষের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে। গোপাল হাঁক ছিলেন, ‘ও রীতা দিদি … ঘরে আছেন?’ পুরো বাড়ি ঘিরে আছে নানা গাছপালায়। লাগোয়া একটা জামরুলগাছের নিচে জামরুল পড়ে আছে প্রচুর, খাওয়ার মতো কেউ নেই। গোপালের হাঁকে কেউ সাড়া দিলেন না। কিন্তু সে শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো সেই প্রাচীন বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে। আমি মুগ্ধ নয়নে এক সময়কার জমজমাট, সরগরম কিন্তু এখন ধ্বংসের প্রান্তে থাকা জমিদারবাড়ির দিকে তাকিয়ে আছি। প্রচণ্ড গরম আর আর্দ্রতায় শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে।

প্রাচীন সেই প্রত্নতাত্ত্বিক সৌন্দর্য দর্শনের উত্তেজনায় আমি সেসব ভুলে গেছি।

জনমানবহীন ভগ্ন প্রাসাদে দূর অতীতের স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে বেড়াচ্ছি। দালানের গায়ে নানা ধরনের গাছ, লতাপাতায় ছেয়ে গেছে। এক রহস্যে ঘেরা পরিবেশ! এক জায়গায় দেখলাম, কয়েকজন গ্রামবাসী গাছ কেটে রশি বেঁধে টেনে আনছেন। তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম, দোতলায় ওঠা যায় কিনা, সিঁড়ি কোন দিকে? তাঁরা জানালেন, সাপ থাকতে পারে, চেষ্টা না করাই ভালো।

গোপাল দাস মন্দিরের ভেতরে একটি পাথরের মূর্তি দেখালেন। সেটাকে নাকি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করেও পুরো ভাঙতে পারেনি। পাশেই একটা মোমবাতি ও মূর্তির গায়ে সিঁদুরের দাগ দেখে বুঝলাম, এখনো এখানে ভক্তরা এসে পুজো দিয়ে যান নীরবে।

লেখক: সংগীতশিল্পী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত