Ajker Patrika

জামিনে বেরিয়ে খুনোখুনিতে ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসীরা

  • শীর্ষ সন্ত্রাসীরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মরিয়া।
  • কেউ আদালতে হাজিরা দেয়নি, জারি হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
  • শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যকার দ্বন্দ্বে আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা।
শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা 
ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের ফটকে তারিক সাইফ মামুনকে গুলিতে হত্যা করা হয়। ইনসেটে তারিক সাইফ মামুন। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া
ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের ফটকে তারিক সাইফ মামুনকে গুলিতে হত্যা করা হয়। ইনসেটে তারিক সাইফ মামুন। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ তারিক সাইফ মামুন হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে রাজধানীর অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দ্বন্দ্ব ও তৎপরতার বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। জুলাই জাতীয় সনদ, গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভিন্নতার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। তাদের অপরাধ সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের চেষ্টা নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে বলে আশঙ্কা করছে পুলিশ।

পুলিশের সূত্র বলছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে কারাগার থেকে বের হওয়ার পর নিজেদের এলাকা দখলে তৎপর হয়ে উঠেছিল। এ নিয়ে হামলা, খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছিল। এসব ঘটনায় মামলার পর প্রকাশ্য তৎপরতা থেমে গিয়েছিল। কিন্তু গত সোমবার হঠাৎ মামুন হত্যাকাণ্ড শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আবার বেপরোয়া হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা, মামুন হত্যার নেপথ্যে এলাকা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসীর দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের কারণে ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মামুনকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। ওই ঘটনায় প্রাণ হারান আইনজীবী ভুবন চন্দ্র শীল।

আদালত ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাত শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পায়। তাদের বেশির ভাগ এক থেকে দেড় যুগ কারাগারে ছিল। কারাগারে থাকাকালেও তারা নিজেদের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করত অনুসারীদের দিয়ে। মুক্তির পর প্রথম দিকে দু-একটি ঘটনায় প্রকাশ্যে এলেও এখন জাতীয় নির্বাচনের আগে তাদের তৎপরতা ঢাকার অপরাধজগৎকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। বাইরে থাকা সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীদের অনুসারীরাও তৎপর হয়ে উঠেছে।

সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর জামিনে মুক্তি পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীরা আত্মগোপন করেছে। কেউ আদালতে হাজিরা দিতে যায়নি। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলেও পুলিশ তাদের কাউকে খুঁজে পায়নি।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, জামিনে বের হওয়া কাউকে নতুন করে অপরাধমূলক কাজে জড়ানোর সুযোগ দেওয়া হবে না। শীর্ষ সন্ত্রাসী, গডফাদার বা যেকোনো পরিচয়েই হোক, অপরাধ করলে তাকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।

২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম প্রকাশ করে। এরপর বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয় কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ অনেক সন্ত্রাসী। গত বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে জামিনে বেশ কয়েকজন মুক্তি পায়। তাদের মধ্যে রয়েছে মোহাম্মদপুরের পিচ্চি হেলাল, তেজগাঁওয়ের শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, মিরপুরের আব্বাস আলী, রায়েরবাজারের খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, মালিবাগ-মগবাজারের খোরশেদ আলম ওরফে রাসু, হাজারীবাগের সানজিদুল ইসলাম ইমন। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টাসহ অনেক মামলা হয়েছিল। কিছু মামলায় সাজা হয়েছে, আবার কিছু মামলায় উচ্চ আদালত থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। মামুন মুক্তি পায় ২০২৩ সালে।

ঢাকার অপরাধজগতের সূত্রগুলো বলছে, জামিনে মুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে কেউ ইতিমধ্যে বিদেশে চলে গেছে, কেউ বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। মিরপুরের এক শীর্ষ সন্ত্রাসী কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর নেপালে চলে গেছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। ইমনও বিদেশে চলে গেছে শোনা যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ পুরোনো রাজনৈতিক পরিচয় কাজে লাগিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টায় আছে। কেউ আবার এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে লোক দিয়ে চাঁদাবাজি করাচ্ছে।

ঢাকার আদালতের একটি সূত্র জানায়, গত বছরের ১৬ আগস্ট জামিনে মুক্তি পায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল এবং খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন। কিন্তু জামিনের পর অন্যদের মতো তারাও আর আদালতে হাজিরা দেয়নি। আদালত তাদের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারে একাধিকবার অভিযান চালিয়েও পারেনি। তবে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) একটি সূত্র বলছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও টিটন দেশের ভেতরই গা ঢাকা দিয়ে আছে। অভিযানের খবর পেয়ে তারা সটকে পড়ছে।

এদিকে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ থাকা পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী, শীর্ষ সন্ত্রাসী আবু রাসেল মাসুদ ওরফে মোল্লা মাসুদ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, গ্রেপ্তারের আগে গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মগবাজারের বিশাল সেন্টারে একটি দোকান দখলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দলবল নিয়ে মহড়া দিয়েছিল সুব্রত বাইন। তিনি বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে ডেকে কথাও বলেছিল। এতে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল।

প্রায় দুই যুগ পর জামিনে মুক্তির পর পিচ্চি হেলালের বিরুদ্ধে গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর রায়েরবাজারে সাদেক খান আড়তের সামনে দুই যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ২২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় মামলা হয়। পুলিশ বলছে, এলাকায় ‘দখল’ নিতে সন্ত্রাসীদের মধ্যে বিরোধে এই জোড়া খুন হয়।

সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা কমিটির এক বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জামিনে মুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গতিবিধি ও কার্যক্রমের ওপর নজর রাখতে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কারাগারে থেকেই বাইরের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করত। জামিনে মুক্ত হওয়ার কারণে তাদের অপরাধের মাত্রা বেড়েছে। তাদের প্রতিহত করতে না পারলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...