Ajker Patrika

আলো-আঁধারির গাঁ

আমিনুল ইসলাম সোহেল, ঢাকা
আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২২, ১৮: ৪৩
আলো-আঁধারির গাঁ

পুরোপুরি অন্ধকার নয়। সামান্য আলো বর্তমান, যা গহিন অরণ্যে ডালপালার ফাঁক গলে দেখা যাওয়া সূর্যরশ্মির মতো; শুধুই আশা জাগায়, পথ চলতে সাহায্য করে না। এমনই এক আলো-আঁধারির গাঁ সদরা কুতুবপুর। রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে চার কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এই গ্রামের অবস্থান।

জনশ্রুতি আছে, কেতাবের বহুবচন কুতুব আর তার সঙ্গে পুর (স্থান) যুক্ত হয়ে গ্রামটির নাম হয়েছে কুতুবপুর। গ্রামবাসীর ধারণা, একসময় এখানে বড় ধরনের কোনো শিক্ষালয় ছিল, আর তাতে ছিল অনেক বই। তাদের এ ধারণাকে পোক্ত করেছে ওই গ্রামের ‘কাগজিপাড়া’। প্রবীণরা মনে করেন, এ পাড়ায় কাগজ উৎপন্ন হতো। কিন্তু সময় তো বুড়ো যাযাবর! এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে না। তাই হয়তো আমরা বঞ্চিত গ্রামের সেই গৌরবময় অতীত ও ইতিহাস থেকে।

আর্থিক দৈন্যই এখানে অন্ধকারের প্রথম ধাপ। এ গাঁয়ের বেশির ভাগ মানুষ শিক্ষার আলো দেখেনি। অভিভাবকেরা সন্তানদের পাঠশালায় পাঠালেও প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে দেন না। ফিরিয়ে আনেন নিজ পেশায়। তাঁদের কাছে ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানই মুখ্য। তাই তো সন্তানদের হাতের কলম হয়ে যায় কাস্তে, বই হয়ে যায় সবুজ খেত। ওদের নবীন মনের স্বপ্নগুলো হয় ধূসর।

তারপরও আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি মাদ্রাসা, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি এতিমখানা ও একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসা। গড়ে উঠেছে একটি ছোট্ট বাজার।

উত্তর-দক্ষিণে লম্বা গ্রামটিতে প্রায় দুই হাজার লোকের বাস। সদরা কুতুবপুর গ্রামের ৯০ শতাংশেরও বেশি লোক কৃষিজীবী। বেশির ভাগেরই নেই নিজের জমি। অন্যের জমিতে বর্গা খাটেন। আধিয়ার হিসেবে পান উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক। বন্যা-খরায় ফসল নষ্ট হয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি গল্পের চরিত্রগুলোর মতো তাঁরাও পড়ে থাকেন অন্ধকারে। মাঝে মাঝে তাঁদের মুখ দিয়েও বেরিয়ে আসে—‘ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লিতে, এখানে তাঁহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’

মধ্যপাড়ার ব্র্যাক পাঠশালায় পড়াতেন খালেদা বেগম। দীর্ঘ পাঁচ বছরে সেখানে অনেক সম্ভাবনাময় শিশুকে দেখেছেন তিনি। কিন্তু একজন ছাড়া ঝরে পড়েছে সবাই। এ নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশার অন্ত নেই তাঁর। তিনি বলেন, ‘অভাব যত দিন এ গাঁয়ে থাকবে, তত দিন এ গাঁয়ের শিশুরাও থাকবে অন্ধকারে।’

কৃষি এ গাঁয়ের অর্থনীতির মূল। কিন্তু তাতেও আসেনি আধুনিকতা। তবে তার বাতাস বইতে শুরু করেছে। দু-একজন কলের লাঙল দিয়ে জমি চাষ করছেন। ধান মাড়াই করতেও ব্যবহার করছেন আধুনিক যন্ত্র। তবে কৃষক বঞ্চিত হচ্ছেন ফসলের ন্যায্য দাম থেকে।

স্বাস্থ্যকর্মী রেহেনা বেগম স্বাস্থ্যসহ নানা বিষয়ে পরামর্শ দেন। তাঁর চেষ্টাতেই গর্ভবতী ও নবজাতকদের টিকা দেওয়ার পাশাপাশি সচেতন স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহারে, নলকূপের গোড়া পাকাকরণে। জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও এখন সচেতন অনেকেই।

গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়া পীরগঞ্জ-মাদারগঞ্জ সড়কটিতে বছর কয়েক আগে পিচ-পাথর বসেছে। গ্রামে বিজলি বাতিও জ্বলেছে বছরচারেক আগে। সেই সঙ্গে আকাশ সংস্কৃতি পৌঁছে গেছে। কিন্তু ঘোরেনি উন্নয়নের চাকা। সামাজিক ব্যাধিগুলোও প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। বিধিনিষেধের মধ্যেও হচ্ছে বাল্যবিবাহ। যৌতুক প্রথা দিন দিন বাড়ছে। রাজনীতি ঢুকে পড়েছে ঘরে ঘরে। সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন আলগা হচ্ছে। গহিন অরণ্যে ডালপালার ফাঁক গলে দেখা যাওয়া সূর্যরশ্মি যেন হঠাৎই মিলিয়ে যায়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ